ভাইরাল তরমুজ বিক্রেতা রনি প্রতারিত

ওই কীরে কী, মধু, মধু…. রসমালাই’, তরমুজ বিক্রি করার সময় এই কথাগুলো বলে ‘ভাইরাল’ হয়েছেন বিক্রেতা রনি। তাঁকে খুঁজছিলাম দুই দিন ধরে।

কারওয়ান বাজারে রনির তরমুজের দোকানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেল তাঁর ছোট ভাই রকিকে। সোমবার সকালে অনেক অনুরোধের পর রকির কাছ থেকে রনির মুঠোফোন নম্বর পেলাম। ফোন করে দেখি নম্বরটি বন্ধ।

পরে গিয়ে রনির আরেকটি নম্বর সংগ্রহ করি। সেই নম্বরে ফোন করলে রনি বলেন, তিনি পুরান ঢাকায়। তিনি মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে আসবেন আমার সঙ্গে কথা বলতে।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ফোন করলে রনি বলেন, তিনি মাত্রই দোকানে এসেছেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে গিয়ে রনিকে পেলাম। মুখে মাস্ক পরা। কেন মাস্ক পরেছেন, সব সময় কি মাস্ক পরেন—জানতে চাইলে রনি বলেন, কেউ যেন তাঁকে চিনতে না পারেন, সে জন্য মাস্ক পরেছেন।

রনি তাঁর দোকানে দাঁড়িয়ে মাস্ক পরা অবস্থায় মিনিট দশেকের মতো আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ভাইরাল’ (আলোচিত) হওয়ার পর এখন তিনি লুকিয়ে থাকছেন। তাঁকে দোকানে দেখলেই ইউটিউবাররা (যাঁরা ইউটিউবে প্রচারের জন্য ভিডিও তৈরি করেন) ভিড় করেন। ভিডিও করতে চান। অনেক মানুষ ছবি তুলতে দোকানে যান। এতে তাঁর আর তরমুজ বিক্রি করা হয় না। পাশাপাশি আশপাশের বিক্রেতারা বিরক্ত হন। এ কারণে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

রনি বলেন, ‘দোকানদারেরা বলছে, “ভাই আপনার জন্য তো আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।” তাই আমি এখন দোকানে থাকতে পারতেছি না। আমার কষ্ট হোক, তবু আমার কারণে আমি কারও ক্ষতি চাই না।’

রনির বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। কারওয়ান বাজারে প্রায় দেড় দশক ধরে মৌসুমি ফল বিক্রি করেন। তরমুজ বিক্রিতে হাতেখড়ি কিশোরকাল থেকে। তিনি বলেন, তাঁর দাদা ও বাবা তরমুজের ব্যবসা করতেন। তাঁদের কাছ থেকে কোনটি পাকা, অর্থাৎ ভেতরে লাল রং ধারণ করা তরমুজ, তা চিনতে শিখেছেন।

এবারের পবিত্র রমজান মাসে আশপাশের বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তরমুজ বিক্রির সময় ক্রেতা আকর্ষণের জন্য ‘ওই কীরে কী, মধু, মধু…রসমালাই’ কথাটি বলতেন রনি। তখন তাঁর হাতে থাকত সদ্য কাটা ভেতরে লাল টুকটুকে তরমুজ। তিনি বলেন, এটা দেখে একজন ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেন। তারপরই তিনি ভাইরাল হন।

রনি বলছিলেন, ভাইরাল হওয়ার পর শত শত ইউটিউবার ও উৎসুক ব্যক্তি তাঁর দোকানে আসেন। তরমুজ বিক্রি ও কেটে দেখানোর ভিডিও করা শুরু করেন। একপর্যায়ে ইউটিউবার ও উৎসুক মানুষের ভিড়ের চাপে তাঁর দোকানে ক্রেতা আসা কমে যায়। আশপাশের দোকানদারেরা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।

রনি আরও বলেন, একপর্যায়ে তাঁর ভাই তাঁকে দোকানে আসতে নিষেধ করেন। তিনি ভাইয়ের কাছে দোকান সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে লুকিয়ে থাকা শুরু করেন।

ভাইরাল হওয়ার পর দোকানের বিক্রি কমে গেছে বলে দাবি রনির। ঢাকা, ১৮ মার্চছবি: নোমান ছিদ্দিক

রনির দোকানে দুই দিন গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ছোট ভাই রকি তরমুজ বিক্রি করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বড় ভাই ভালো তরমুজ চেনে। তবে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে এখন দোকানে অতিরিক্ত মানুষ ভিড় করে, ফলে আর এখন আগের মতো তরমুজ বিক্রি হচ্ছে না।’

কারওয়ান বাজারে সবজির আড়তের সামনে ফলের ভাসমান দোকানগুলোর একটি রনি ও রকির। সেখানে আরও ফলবিক্রেতা রয়েছেন। তাঁদের একজন শুভ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে (রনি) যখন দোকানে আসে, তখন আশপাশের লোকজন থেকে শুরু করে ইউটিউবাররা ভিড় করেন, ফলে ভিড়ের কারণে আমাদের দোকানে কাস্টমার আসতে পারে না। মাল বেচাকেনা হয় না। আমাদের আশপাশের সবার ক্ষতি হচ্ছে।’

‘সে (রনি) ভাইরাল হয়েছে ভালো কথা, তাতে আমাদের ক্ষতি নেই। আমরা চাই যাতে সে শান্তিশৃঙ্খলাভাবে ব্যবসা করে’, বলেন শুভ।

উৎসুক জনতা ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড়ের কারণে রনি এখন আর দোকানে বসেন না। ঢাকা, ১৮ মার্চছবি: নোমান ছিদ্দিক

রনির দোকানের পাশেই দীর্ঘদিন ধরে লেবু বিক্রি করছেন জাহাঙ্গীর নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, রনি ভাইরাল হওয়ায় তাঁরও (জাহাঙ্গীর) ক্ষতি হয়েছে। আগে প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩ হাজার লেবু বিক্রি করতেন তিনি। এখন ৫০০টি বিক্রি করতেই কষ্ট হয়।

রনি ভাইরাল হওয়ার পর যাঁরা তাঁর কাছ থেকে তরমুজ কেনা ও ছবি তুলতে আসছিলেন, তাঁদের একজন জামাল। সোমবার রনির দোকানে গিয়ে পাওয়া গেল জামালকে, যিনি তেজকুনিপাড়া থেকে এসেছেন। যদিও রনি দোকানে ছিলেন না।

জামাল প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিও দেখেই তিনি এসেছেন। যদিও রনিকে পাননি। তবে তিনি রনির ভাইয়ের কাছ থেকে তরমুজ কিনেছেন।

বিজ্ঞাপনের মডেল রনি

ভাইরাল হওয়ার পর কিছু প্রতিষ্ঠান রনিকে তাদের বিজ্ঞাপনে নিয়েছে। বিজ্ঞাপন করে কত টাকা পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, ‘সবাই আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমাকে মোবাইল গিফট করবে বলে একটি দোকানে নিয়ে বিজ্ঞাপন করে ছেড়েছে, কিন্তু আমাকে কিছুই দেয়নি। ডেকে নিয়ে তারা আমাকে টাকা দেয়নি, বরং নাটক করেছে।’

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি সহায়িকার বিজ্ঞাপনেও নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করে রনি বলেন, ‘তারা বিজ্ঞাপন করেছে পুরস্কার দেবে বলে। কিন্তু পরে তারা ভাইগ্যা গেছে। আর কিছুই দেয়নি। যদিও আমি কারও কাছে টাকা চাই না।’

রনি বলেন, ‘শুধু পিৎজা বার্গ আমার কাছ থেকে কিছু তরমুজ কিনেছে। আর বাকি সবাই প্রতারণা করেছে। আমি ট্যাকাপয়সা চাই না দাদা, আমি চাই ভালোবাসা।’

রনির সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই তাঁর ছোট ভাই রকি তাঁকে ডেকে নিয়ে যান। রকি বলেন, ‘ভিড়ের কারণে সবার সমস্যা হয়। কাস্টমার আসে না।’

দেখলাম, মাস্ক পরে রনি অন্যদিকে চলে গেলেন।

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments