রমজানে স্কুল খোলা রাখার পক্ষে চুড়ান্ত রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট

রমজান মাসে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হাই কোর্ট যে আদেশ দিয়েছিল, তা স্থগিত করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

শুনানি শেষে মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন।

এর ফলে রমজান মাসের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে আর কোন বাধা নেই বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান।

আদেশ অনুযায়ী, বুধবার থেকেই সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল বিদ্যালয় খোলা রাখতে হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এর আগে, গত রোববার হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ রুল দিয়ে রমজানের প্রথম ১০ দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম ১৫ দিন খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দুই মাসের জন্য স্থগিত করেছিল।

সেই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

সোমবার চেম্বার আদালতের বিচারপতি আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। মঙ্গলবার সকালে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শেষে স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত এলো।

তবে হাইকোর্টের আদেশের পর আপিল করা হলেও, সেখানে কী সিদ্ধান্ত আসবে সেটা পরিষ্কার না হওয়ায় স্কুল খোলা রাখা-না রাখার বিষয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় অনেক কর্তৃপক্ষ।

এমন পরিস্থিতিতে বেশ কিছু বিদ্যালয় মঙ্গলবার ছুটিও ঘোষণা করে।

আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকায় মঙ্গলবার বেশ কিছু বিদ্যালয় ছুটিও ঘোষণা করা হয়
আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকায় মঙ্গলবার বেশ কিছু বিদ্যালয় ছুটিও ঘোষণা করা হয়

যে যুক্তি দেখিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ

মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। অন্যদিকে, রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী একেএম ফয়েজ।

শুনানির শুরুতে রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি বলেন, রমজানের মধ্যে সৌদি আরবে ২৮শে মার্চের আগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে।

একইভাবে, ইরান, তুরস্ক, মিশর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রেরও উদাহরণ টানেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কপি আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি।

“মুসলিম প্রধান কোনো দেশেই, কোথাও রমজানে স্কুল বন্ধ থাকে না। কোথাও দশ দিন ছুটি নাই…..কাজেই এটি কোনোভাবেই আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়”, গণমাধ্যমকে বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

তিনি আরও বলেন, “সবদিক বিবেচনা করে সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আইনের পরিভাষায় একে বলা হয় পলিসি ডিসিশন”

“আর পলিসি ডিসিশনের ব্যাপারে কোনোভাবেই আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। আমরা এটিই বলেছি।”

তার এই যুক্তির বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে না পারায় আপিল বিভাগ হাই কোর্টের স্থগিত আদেশ খারিজ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এদিকে, রিট আবেদনকারীর আইনজীবী একেএম ফয়েজ শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বলেছিলাম যে, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। আমাদের দেশে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও ভোগান্তি হয়।”

“কিন্তু পলিসিগত বিষয় হওয়ায় হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। কাজেই স্কুল খোলা থাকবে”, সাংবাদিকদের বলেন মি. ফয়েজ।

শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে ছুটির তালিকা ও শিক্ষাপঞ্জি আংশিক সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়
শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে এবছর ছুটির তালিকা ও শিক্ষাপঞ্জি আংশিক সংশোধন করেছে সরকার

যেভাবে আপিল বিভাগে গেল

শুরুতে এবারের রমজানে ৩০ দিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর এ সংক্রান্তএকটি প্রজ্ঞাপনও প্রকাশ করা হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে ছুটির তালিকা ও শিক্ষাপঞ্জি আংশিক সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে ছুটির তালিকা ও শিক্ষাপঞ্জি আংশিক সংশোধন করে রমজানের প্রথম ১০ দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালু রাখা হবে।

আর রমজানের প্রথম ১৫ দিন সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল শিক্ষা বিভাগ।

এরপর সরকারের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে হাই কোর্টে রিট করেন শফিউর রহমান চৌধুরী নামে এক অভিভাবক।

ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গত রোববার হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল দিয়ে রমজানের প্রথম ১০ দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম ১৫ দিন চালু রাখার সিদ্ধান্ত দুই মাসের জন্য স্থগিত করে।

রিট আবেদনকারীর পক্ষে হাই কোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী একেএম ফয়েজ এবং আইনজীবী মাহমুদা খানম।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল রেহেনা সুলতানা।

রমজানের প্রথম ১০ দিন প্রাথমিক এবং ১৫ দিন নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে
রমজানের প্রথম ১০ দিন প্রাথমিক এবং ১৫ দিন নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে

শুনানিতে মি. ফয়েজ বলেন, রমজানে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে এবং বাড়ি ফিরতে যানজটসহ নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই তাদের পক্ষে রমজানে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করা কষ্টকর।

“বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর আদালত সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রথম রোজা থেকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে দুই মাসের রুল জারি করেছেন” রোববার শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন মি. ফয়েজ।

এরপর হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

সোমবার বিষয়টি আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে।

আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাই কোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ না দিয়ে বিষয়টি মঙ্গলবার আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য রাখেন।

সে অনুসারেই মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়।

এসময় উভয়পক্ষের তাদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন।

শুনানি শেষে হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত করে আপিল বিভাগের পক্ষ থেকে রমজানে স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শেখ সাইফুজ্জামান।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments