বাংলাদেশে শুক্রবার সকালে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়ের হিলরা গ্রামে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া এক মেয়ে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
মহেড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বাদশা মিয়ার সাথে যখন সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল তখন তিনি জানান, সকাল ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পান তিনি। ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে জানতে পারেন, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ওই শিক্ষার্থীর মা তাকে বাসায় রেখে বাজারে যান।
সকাল আনুমানিক সাড়ে দশটার দিকে তিনি বাসায় ফিরলে, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় ঘরে ঢুকতে না পেরে বাড়ির মালিককে ডাকেন। পরে দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে, ওই শিক্ষার্থীকে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান।
বাদশা মিয়া বলেন, তিনি পুলিশের সহায়তায় মরদেহটি উদ্ধার করেন এবং পরে সেটি ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
ওই শিক্ষার্থীর আর কোন ভাই-বোন নেই। তবে তার মা বলতে পারেননি যে, তার মেয়ে কেন আত্মহত্যা করেছে।
এই শিক্ষার্থী একা নন, বাংলাদেশে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সব মিলিয়ে ওই বছরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ের মোট ৪৪৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে শিক্ষার্থী।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর থেকে তথ্য নিয়ে করা তাদের এক জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রতিদিনই একাধিক স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।
এছাড়া ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়েও আত্মহত্যা করেছে ৮৬ জন শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যার বিভিন্ন ধরণের কারণ থাকলেও এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় কোন কারণ জানা যায় না।

কেন আত্মহত্যা করে শিক্ষার্থীরা?
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বিবিসি বাংলাকে জানান, ২০২০ সাল থেকে তারা আত্মহত্যা নিয়ে নানা ধরণের জরিপ চালিয়ে আসছেন। এরমধ্যে এ বছরই প্রথম স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে কাজ করেছেন।
এতে তারা দেখতে পেয়েছেন যে, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়া এবং আর্থিক সংকটের কারণেই বেশি আত্মহত্যা করে থাকে।
কিন্তু স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া আত্মহত্যার করা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এই পথ বেছে নেয় পরিবারের সমস্যদের উপর মান-অভিমানের কারণে। উদাহরণ হিসেবে মি. রোজ বলেন, কেউ হয়তো মোটরসাইকেল কিনতে চেয়েছে, সেটি না পেয়ে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ হয়তো গেমস খেলতে চেয়েছে, তাকে বারণ করায় আত্মহত্যা করেছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, এই হার প্রায় ২৭ শতাংশের বেশি।
এ বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার দ্বিতীয় বড় কারণ হচ্ছে প্রেমঘটিত। প্রায় ২৩ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে প্রেমঘটিত কারণে।
এছাড়া পারিবারিক কলহ, হতাশা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌণ হয়রানি, আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারা, পড়াশুনার চাপসহ নানা কারণ রয়েছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে।

‘না’ কে মেনে নিতে না পারা
জরিপ বলছে যে, পরিবারের সদস্যদের সাথে মান অভিযান যেমন তরুণ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একটি বড় কারণ তেমনি আরো কিছু বিষয় রয়েছে যার কারণেও তারা আত্মহত্যা করেছে।
যেমন, গেইম খেলতে বাধা দেয়ায় ৭ জন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন, মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায় ১০ জন, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, তরুণ শিক্ষার্থীরা কোন কিছু না পাওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিতে না পারা বা এক কথায়, “না” শুনতে না পারার মানসিকতায় অভ্যস্ত হওয়ার কারণে
ছোটখাট বিষয়েও অতি আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যা করে বসতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বেশিভাগ সময়ে এটা ক্ষণিকের সিদ্ধান্তেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে ফেলছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনার অংশ নয়।
সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে পরিবারের সদস্যদের সাথে মান-অভিমানের জেরে।
মিজ সরকার বলেন, রাগারাগি হলে ওই সময়ে তীব্র অভিমানকে সামাল দিতে না পারলে তার মনে হয় যে, মৃত্যুই হচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার একটা পথ।
“এক্ষেত্রে বেশিরভাগই কিন্তু এদের মধ্যে হলো চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতাটা কম বা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কম।”
সবশেষ জরিপ বলছে যে, স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীরা তাদের বয়সের কারণে একটা বয়ঃস্বন্ধিকাল অতিক্রম করে এবং এ সময়ে তাদের আবেগের নিয়ন্ত্রণ করাটাও কঠিন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়টাতে ছোট কোন ঘটনাও প্রচণ্ড আবেগের জন্ম দিতে পারে। যার কারণে তারা হুটহাট নানা ধরণের মারাক্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।

এক্ষেত্রে পরিবার বিশেষ করে বাবা-মায়ের সন্তান লালন-পালনের ধরণ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। যে পরিবারে সন্তানকে ছোট থেকে সব ধরণের আবদার মেনে নেয়া হয় সে পরিবারের শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম থাকে।
এ ধরণের শিশুরা সামাজিক মেলামেশা কম করে কারণ তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খুব বেশি মানিয়ে নিতে চায় না।
এক্ষেত্রে বাচ্চাদের ছোট বেলা থেকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলে, বা বড় হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে – এমন মনোভাব থেকে সব কিছু মেনে নিলে পরোক্ষভাবে তাকে ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দেয়া হয়। কারণ সময়ের সাথে সাথে তখন তাদের চাহিদাও বড় হতে থাকে।
এমন অবস্থায় বাবা-মা যখন হঠাৎ করে তাদের চাহিদার লাগাম টানতে চায়, তখনি তারা তাদের আবেগের মোকাবেলা করতে পারে না। এর এক পর্যায়ে তারা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিয়ে নিতে পারে।
একই ধরণের অবস্থায় হয় রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেসব শিশু ‘না’ শুনতে পারে না তারা বড় হয়ে রোমান্টিক সম্পর্কেও সমস্যায় পড়ে। সম্পর্ক বা তার পছন্দের বিষয়টি যে তার ইচ্ছামতো নাও হতে পারে, সেটি তারা মেনে নিতে পারে না। যার কারণে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে সে।
এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া উচিত উল্লেখ করে মেখলা সরকার বলেন, অতিরিক্ত শাসন ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ যেমন বাচ্চাদের মধ্যে হীনমণ্যতা তৈরি করে তেমনি, নিয়ন্ত্রণের রশি সন্তানের হাতে দিলেও সেটা মঙ্গলকর হয় না।
হতাশা, বিষন্নতা বা উদ্বেগের মতো মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা।