মেনোপজে বা অনিয়মিত মাসিকে ভয় নয়

জাহানারা বেগম, বয়স ৪৮ বছর। প্রায় এক বছর ধরে তাঁর পিরিয়ড অনিয়মিত হতে থাকে। কোনো মাসে পিরিয়ড হয়, কোনো মাসে হয় না, কখনও সময়ে হয়, কখনও অসময়ে হয়। তাঁর শারীরিক সম্পর্ক করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে, হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, হঠাৎ করে তীব্রভাবে ঘাম হয়, যেটা হট ফ্ল্যাশ নামে পরিচিত। এটি মধ্যবয়সে নারীর শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া- মেনোপজ।

একটি নির্দিষ্ট বয়সে গিয়ে নারীর মাসিক বন্ধ হয়, যা মেনোপজ। এ দেশে নারীদের মেনোপজের গড় বয়স ৫১ বছর। মেনোপজের বয়স প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন। মেনোপজের প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে ঘটে। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের মেনোপজ হয়ে থাকে। অনেক সময় এই বয়সের মধ্যে থেমে থেমে কয়েক মাস পরপর ঋতুস্রাব হতে পারে। অনেক সময় কোনো অস্ত্রোপচারের কারণে যদি কোনো নারীর দুটো ওভারি অথবা জরায়ু ফেলে দিতে হয়, তাহলেও হঠাৎ মেনোপজ হয়ে যায়। তবে একটানা ১২ মাস যখন ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে, তখন সেটিকে চিকিৎসকরা মেনোপজ বলে থাকেন।

সমাজের অধিকাংশ নারী যখন জীবনের এই পর্যায়টা অতিবাহিত করেন, তখন তাঁরা এ সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে খুবই অনিরাপদ বোধ করেন। মেনোপজকে বৃদ্ধ হওয়ার লক্ষণ ভেবে তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পান। অনেকে আবার নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাঁদের মাসিক নিয়ে মিথ্যাও বলে থাকেন। তাঁদের ভয় হয়, মেনোপজের বিষয়টা স্বামীরা জানতে পারলে যদি তাঁদের নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দেন কিংবা তাঁদের আর ভালো না বাসেন। সমাজের এই মানসিকতা নারীর জীবনের খুব স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়াকে একটা সামাজিক ট্যাবুতে পরিণত করছে।

একজন নারীর মধ্যে মেনোপজ নিয়ে অনেক ধরনের হতাশা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে ওই নারীর প্রতি তাঁর নিজের যত্নশীল হতে হবে। পরিবারের সবারও বিশেষ করে জীবনসঙ্গীকে নিতে হবে বড় দায়িত্ব। নারীকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হবে। তাঁর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব যে একটুও কমেনি, এটি বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মেনোপজ মানেই নারীর জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়; বরং নতুন করে নিজেকে ভালোবাসুন, যত্ন নিন ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন। মেনোপজ নারীজীবনের একটি স্বাভাবিক অধ্যায়। কোনো কোনো নারীর ক্ষেত্রে তেমন কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না।

তবে বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে লক্ষণ থাকে। যেমন হট ফ্ল্যাশ বা গরম ঝলকানি। এই লক্ষণটি নারীরা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন। কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে অনুভূতি। হট ক্লাসের সময় মুখমণ্ডল, ঘাড়, গলা লালাভ হয়ে ঘেমে যেতে পারে। কেউ কেউ দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। কারও কারও হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে পারে, মানসিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। দিনে বা রাতে এই হট ফ্ল্যাশ কয়েকবার অনুভূত হতে পারে। মাথা ব্যথা, ক্লান্ত অনুভব করা, দ্রুত উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, দৈহিক মেলামেশায় আগ্রহ কমে যাওয়া, হরমোনের তারতম্যের কারণে যোনিপথের স্বাভাবিক পিচ্ছিলতা কমে জ্বালাপোড়া অনুভব করা, স্তন শিথিল হয়ে যাওয়া, মাথার চুল দ্রুত ঝরা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মেনোপজের আগে থেকেই হাড়ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। এ সময় দৈনিক ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই প্রতিদিন দুধ, দুগ্ধজাত খাবার, পনির, সয়াবিন, কাঁচা বাদাম, আখরোট, কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার বিষণ্ণতা, অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করে। সেলেনিয়াম হট ফ্ল্যাশ কমায়। কলিজা, টুনা মাছ, টমেটো, পেঁয়াজ, ব্রোকলি, রসুন ইত্যাদিতে সেলেনিয়াম আছে। সয়াসমৃদ্ধ খাবার ও বিনস হট ফ্ল্যাশ কমাতে সাহায্য করে।

লেখক : পুষ্টিবিদ, গুলশান ডায়াবেটিক কেয়ার

সূত্র : সমকাল

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments