রাজধানীতে দিনে ৩৭টি বিবাহ বিচ্ছেদ! ৬৫ শতাংশই ঘটাচ্ছেন নারীরা

রাজধানীতে দিনে ৩৭টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। যার অর্থ ঘণ্টায় তালাক হচ্ছে একটির বেশি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যে, গেল বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ২৬৮টি তালাক দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে তালাক হয়েছে এক হাজার ১১৫টি। এদিকে মোট হিসাবের মধ্যে সাত হাজার ৮৯০টি তালাক দিয়েছেন নারীরা এবং পুরুষরা দিয়েছেন চার হাজার ৩৭৮টি তালাক। অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ তালাক দিয়েছেন নারী আর ৩৫ শতাংশ তালাক দিয়েছেন পুরুষরা।

এর আগে ২০২০ সালে দুই সিটি করপোরেশনে মোট তালাক কার্যকর হয়েছে ১২ হাজার ৫১টি এবং ২০২১ সালে করোনা মহামারির সময় এ সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৬৬১।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্যানুযায়ী, গড়ে বিবাহিত নারী-পুরুষের দশমিক ৪২ শতাংশই তালাকপ্রাপ্ত। সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে রাজশাহীতে, আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে খুলনা ও সিলেট; তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে ঢাকা ও ময়মনসিংহ।

এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে স্বামীর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৯২ জন নারী, আর আত্মহত্যা করেছেন ৯৭ জন। যৌতুকের জন্য নির্যানের শিকার হয়েছেন ১৭৪ জন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, পুরুষরা বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে মূলত স্ত্রীদের প্রতি তাঁদের সন্দেহ, সংসারের প্রতি স্ত্রীর উদাসীনতা, বদমেজাজ, সন্তান না হওয়া ইত্যাদি দেখিয়েছেন। আর নারীরা পরকীয়া প্রেম, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, সন্তান ও তাদের ভরণ-পোষণ না দেওয়াকে দায়ী করেছেন।

তালাকে নিয়ম হচ্ছে মেয়রের দপ্তরে আবেদন নথিভুক্ত করতে হয়। এ আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষ আপস কিংবা প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হয়। এ বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বেশির ভাগ তালাক দিচ্ছেন নারীরা। পারিবারিক বোঝাপড়ার অভাব নিয়েই মূলত তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে। পাশাপাশি নারীরা এখন বেশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাই তালাকের পর কিভাবে চলবেন তা  নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। সমাজও এখন মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা স্বাভাবিকভাবে দেখতে শুরু করেছে। তবে তালাকের আগে সিটি করপোরেশন থেকে উভয় পক্ষকে তালাক না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়াসহ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য ভাবতে বলা হয়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের মত বদলাতে পারেন না।

রাজধানীর মিরপুরে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়েছেন এক নারী। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার স্বামী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেকভাবে চেষ্টা করেছি তাঁকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। এ সম্পর্কের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তিনি আমাকে কথাও দেন, সেখান থেকে ফিরে আসবেন। আমিও তাঁকে বিশ্বাস করি। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই আমি আবারও তাঁকে সেই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখি। তখন আমি সম্পর্ক বন্ধ করার জন্য চাপ দিলে তিনি আমার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে তালাকের আবেদন করেছেন মোহাম্মদপুরের এক পুরুষ। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্ত্রী ক্যারিয়ারের প্রতি বেশি আগ্রহী এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদাসীন থাকায় তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বিবাহবিচ্ছেদের এই প্রবণতার মধ্যে আশার কথা হলো, দীর্ঘদিন ধরে বিবাহিত জীবন পার করছেন বেশির ভাগ দম্পতি। এমন কিছু দম্পতির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, বিবাহবিচ্ছেদকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেন তাঁরা। দাম্পত্য জীবনে ভালো থাকতে হলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন তাঁরা। সামাজিক নিরাপত্তা এবং একে অপরের প্রতি নির্ভরতার কারণে তাঁরা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের নেতিবাচক ধারণা থেকে সমাজ এখন অনেকটা বেরিয়ে এসেছে। যেসব মেয়ে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারেন সে ক্ষেত্রে সমাজও সহযোগিতামূলক আচরণ করছে। এমনকি প্রান্তিক পর্যায়েও মেয়েরা বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তার মূল কারণ তাঁরা মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করতে চান না। নারীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এর একটি কারণ। তার পরও পরিবার সাপোর্ট দিচ্ছে। আবার অনেকে সামাজিক ট্যাবু, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, পরিবারের দিকে তাকিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখছেন।

‘আবার খুব ছোট ছোট কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। এসব বিষয় থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। অনেক সময় দুজনের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক সমস্যা সমাধান করে ফেলা যায়। এসব ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত না নেওয়াই উচিত। কারণ বিচ্ছেদের পর সন্তানের ওপর বড় একটা মানসিক প্রভাব পড়ে,’ বলেন অধ্যাপক জিনাত হুদা।

সূত্র : কালের কণ্ঠ

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments