বিদেশ ফেরত সরওয়ার মাছ চাস করে কোটিপতি

ভাগ্যবদলের জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন সরোয়ার আলম। গিয়েছিলেনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। কিন্তু সেখানে সুবিধা করতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরায় নানা জনের নানা কথা। কিন্তু তাতে দমে যাননি তিনি। বাবার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। তারপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন কোটিপতি বিদেশফেরত সরোয়ার।

চট্টগ্রাম নগরের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ঠান্ডাছড়ি পার্কসংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে সরোয়ারের মৎস্য খামার। সেখানে ১৫ একর জায়গায় তাঁর ১৪টি পুকুর। সরোয়ার জানান, তাঁর খামারে এখন ২১ জন কাজ করেন। যাঁদের বেতন ৯ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সরোয়ারের কণ্ঠে যেন তৃপ্তির ঢেকুর। বললেন, বছরে দেড় কোটি টাকার বেশি মাছ বিক্রি করেন। তাঁর পুকুরে চাষ হয় পাঙাশ, শিং, কই, বাটা ও কার্ফ জাতীয় মাছ।

এই সফলতার পেছনের গল্পটা কেমন ছিল, জানতে চাইলে তিনি খানিকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। বলেন, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে এক পা, দুই পা করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। দেশে ফিরে এসে হাল ছাড়েননি। উদ্যোক্তা তাঁকে হতেই হবে—এটাই ছিল তাঁর সংকল্প।

সরোয়ার জানান, ৬ ভাই, ৫ বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা আনু কোম্পানির গরুর খামার রয়েছে। বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলমের ইটভাটা, সঙ্গে মাছের ব্যবসাও আছে। পরিবারের অন্য ভাইয়েরাও ব্যবসায়ী। এ কারণে ছোটবেলা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর।

২০০৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পড়া সরোয়ার পাড়ি জমিয়েছিলেন দুবাই শহরে। সেখানে অন্য প্রবাসীদের মতো চাকরিও শুরু করেছিলেন তিনি। চাকরি করতে করতেই উদ্যোগ নেন ব্যবসার। পরে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন রেস্তোরাঁর ব্যবসা। সেই ব্যবসা আলোর মুখ না দেখায় পরের বছরই দেশে ফিরে আসেন সরোয়ার।

১৫ একর জায়গায় ১৪টি পুকুরের মাছ চাষ করছেন সারোয়ার

১৫ একর জায়গায় ১৪টি পুকুরের মাছ চাষ করছেন সারোয়ার

সরোয়ার বলেন, দেশে ফিরে এলে অনেকে চাকরি-বাকরি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু চাকরিতে কিছুতেই মন থেকে সাড়া পাচ্ছিলেন না তিনি। ২০১০ সালের শেষের দিকে ঠান্ডাছড়ি এলাকায় পরিত্যক্ত ইটভাটার কুয়ায় শুরু করেন মাছ চাষ। তখন ব্যবসায়ী বাবা আনু কোম্পানি তাঁর পাশে দাঁড়ান। বাবার কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রথম বছর লাখখানেক টাকা লাভ হয়। এরপর আশপাশের পরিত্যক্ত জমিতে মাছ চাষ শুরু করলে সেখানেও সফলতা পান। পরের বছর লাভ করেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। এভাবে বছর বছর বাড়তে থাকে পুকুর ও মাছের সংখ্যা।

মাছ চাষ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে সরোয়ার বলেন, আশপাশে পড়ে থাকা জমিগুলোকে কাজে লাগিয়ে পুকুরের সংখ্যা আরও বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। কম জায়গায় যাতে বেশি মাছের চাষ করা যায়, এ জন্য প্রশিক্ষণও নিয়েছেন তিনি।

তরুণদের উদ্দেশে সরোয়ারের পরামর্শ—চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হন। এতে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানও করা যায়। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা থাকে।

আমদানি করা মাছের খাদ্যের ওপর সরকারি শুল্ক কমানোর জন্য আবেদন সরোয়ারের। তিনি বলেন, মাছের খাদ্যের দাম বাড়লেও বেশি দামে মাছ বিক্রি করতে পারেন না। মৎস্য খামারিরা যাতে লোকসানে না পড়েন, সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত।

সরোয়ার এখন অনেকের জন্য অনুকরণীয়। প্রায়ই পরামর্শ নিতে তাঁর খামার পরিদর্শনে আসেন নতুন উদ্যোক্তারা। তাঁদেরই একজন আক্কাসুল ইসলাম নামের এক তরুণ। সরোয়ারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে গড়ে তুলেছেন মৎস্য খামার। আক্কাসুল প্রথম আলোকে বলেন, সরোয়ারকে দেখে তাঁর মতো অনেক তরুণ উদ্যোগী হয়েছেন।

সরোয়ারের মৎস্য খামার এলাকার বাসিন্দা অধ্যাপক ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তরুণ উদ্যোক্তা সরোয়ার এখন অনেক তরুণের জন্য অনুকরণীয়। বিদেশফেরত প্রবাসীরা হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা করলে তাঁর মতো সফল হতে পারেন।

সরোয়ারের মৎস্য খামার বেকারদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অন্যতম উদাহরণ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে সরোয়ারের মতো এগিয়ে আসতে হবে। তাঁর খামারে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি আমিষের অভাব পূরণ হচ্ছে।

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments