টিন ঈগল ইংলিশ প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতলেন বাংলাদেশের নাহিয়ান মেহজাবিন

৬ আগস্ট ২০২২। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে তখন ‘টিনইগল’–এর চূড়ান্ত পর্বের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। একে একে সম্মানজনক পদক, ব্রোঞ্জপদক, রৌপ্যপদক ও স্বর্ণপদকজয়ীদের নাম ঘোষণা হলো। বাংলাদেশি প্রতিযোগী নাহিয়ান মাহজাবীন ভাবছিল, এত দূর আসার কষ্টটা বোধ হয় বৃথাই গেল। খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে।

একসময় এই আন্তর্জাতিক ইংলিশ প্রতিযোগিতার পুরো আয়োজনটির ‘সেরা তিন’জনের নাম ঘোষণা করা শুরু হলো। তৃতীয় সেরা, দ্বিতীয় সেরার পর চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শোনা গেল মাহজাবীনের নাম। ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলের এ ছাত্রীর তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যিই মঞ্চে তাকে ডাকা হচ্ছে!

মিলনায়তনের ওপরের সারিতে ততক্ষণে মাহজাবীনের মা শাম্মি আখতার ও বাবা নিসার খান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার শুরু করেছেন। ওড়াচ্ছেন বাংলাদেশের পতাকা। বাবার চোখে পানি। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ ৪৪টি দেশের ৫০০ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ‘টিনইগল’ প্রতিযোগিতার ২০২২ আসরে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি জিতে নিয়েছে মাহজাবীন।

প্রতিবছর লন্ডনে বসে আন্তর্জাতিক ইংরেজি প্রতিযোগিতা টিনইগলের চূড়ান্ত আসর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেয়। কুইজ, ইংরেজিতে লেখালেখি, বানান ও বক্তৃতা—চার বিভাগে দেখাতে হয় দক্ষতা।

তবে লন্ডনের চূড়ান্ত পর্বে অংশ নিতে হলে আগে পার হতে হয় প্রাথমিক পর্ব। পর্বটির নাম ‘টিনইগল অনলাইন’। সারা পৃথিবী থেকে অনলাইনে এই পর্বে অংশ নেয় অনেক শিক্ষার্থী। অনলাইন প্রতিযোগিতায় শিশুকিশোর উপযোগী একটি বই ও একটি চলচ্চিত্র নির্ধারিত থাকে। নির্ধারিত বই ও চলচ্চিত্র থেকে ৫০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এক ঘণ্টায়। চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছাতে ৮০ শতাংশ নম্বর প্রয়োজন। গ্লোবাল ফাইনালসে চার দিন চার বিষয়ে এক ঘণ্টা করে পরীক্ষা হয়।

স্কলাস্টিকা স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড নাইনের শিক্ষার্থী নাহিয়ান মাহজাবীন ‘টিনইগল’ প্রতিযোগিতার খোঁজ পায় স্কুল থেকেই। প্রতিযোগিতার জন্য নির্ধারিত বইটি তার আগেই পড়া ছিল। তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই সে অনলাইনে প্রাথমিক পর্বে অংশ নেয়। চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছাতে প্রয়োজন ছিল ৮০ শতাংশ নম্বর। প্রাথমিক পর্বে ৯০ শতাংশেরও বেশি নম্বর পায় মাহজাবীন, জিতে নেয় স্বর্ণপদক। বাংলাদেশ থেকে মাহজাবীনসহ ছয় শিক্ষার্থীর কাছে আমন্ত্রণ আসে চূড়ান্ত পর্বের, যার নাম ‘গ্লোবাল ফাইনালস’।

স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতেই চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি নিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে মাহজাবীন। পুরো ছুটিটা সে পড়াশোনা করে কাটিয়ে দেয়। অন্তত একটি পদক জিততেই হবে—এই ছিল তার লক্ষ্য। ধীরে ধীরে ‘গ্লোবাল ফাইনালস’-এর দিনক্ষণ এগিয়ে আসে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ৩০ জুলাই পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে রওনা হয় মাহজাবীন। মা-বাবা সঙ্গে গেলেও, বিমানবন্দর থেকেই মাহজাবীনকে আলাদা হয়ে যেতে হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে আড্ডার সময় সে বলছিল, ‘চূড়ান্ত পর্বের আগে সাত দিন পরিবার ছাড়া থাকতে হয়েছে। এই একটা সপ্তাহ কাটাতে সত্যিই খুব কষ্ট হয়েছে।’ বাকি দিনগুলোয় অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে মাহজাবীন ঘুরে দেখেছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লন্ডন আই, টাওয়ার ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি জায়গা।

দেশ ছাড়ার আগে থেকেই বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল মাহজাবীন। আন্তর্জাতিক এই মঞ্চে একবার হলেও সে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে চেয়েছিল। তাই ছোট, বড় ও মাঝারি—তিন সাইজের পতাকা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। বড় পতাকা গায়ে জড়িয়ে চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার হাতে নেওয়ার ইচ্ছাটা ছিল প্রথম থেকেই। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

ইংল্যান্ডে গিয়ে শুধু চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নয়, বিভিন্ন দেশের বন্ধুও জুটেছে। মা-বাবাকে ছাড়া এক সপ্তাহ কাটিয়ে মাহজাবীন শিখে ফেলেছে অনেক কিছু। রান্নাবান্না, কাপড় গোছানোসহ সব কাজ যে নিজেকেই করতে হয়েছিল। দেশে ফিরে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে নিজের কাজ নিজেই করবে।

ক্লাসে সব সময় ফার্স্ট হওয়া মাহজাবীন পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। স্কুলের হয়ে সে নিয়মিত অংশ নেয় ছায়া জাতিসংঘের সম্মেলনে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও মাহজাবীন বাংলা বইয়ের ভক্ত। এ অভ্যাসটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। স্কুলের বাস্কেটবল দলের সে নিয়মিত খেলোয়াড়। ভলিবল ও দাবা খেলাটাও বেশ পছন্দ। মাহজাবীন যোগ করল, ‘আর হ্যাঁ, স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাবেরও আমি সাধারণ সম্পাদক।’

তিন ভাই-বোনের মধ্যে মাহজাবীন মেজো। বড় ভাই পড়ছেন ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে, রসায়ন প্রকৌশল বিভাগে। ছোটবেলা থেকেই প্রায় সব কিছুতে বড় ভাইকে অনুসরণ করে মাহজাবীন। তাই বড় হয়ে সে-ও হতে চায় রসায়ন প্রকৌশলী।

শেষ করার আগে আরও সুসংবাদ জানাই। বাংলাদেশ থেকে ‘টিনইগল’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেওয়া অন্য প্রতিযোগীদের মধ্যে স্কলাস্টিকা স্কুলের শিক্ষার্থী প্রজ্ঞা সাহা স্বর্ণপদক জিতেছে। ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুলের রাফিদ জলিল জিতেছে রৌপ্যপদক। আর একই স্কুলের শিক্ষার্থী আল আকসা তানজিম খান, আফছিন হোসেন ও আরেফিন জয় মাদুরজা পেয়েছে সম্মানজনক পদক।

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments