আয়মান আল-জাওয়াহিরি আসলে সাধারণ কিন্তু খুব কার্যকর নেতা ছিলেন। তবে তাঁর মৃত্যু আল কায়দাকে সাময়িক সময়ের জন্য সংকটে ফেললেও দীর্ঘমেয়াদে দলটির খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। এক দশক আগে তাঁর মৃত্যু হলে হয়তো আল কায়দার বড় কোনো ক্ষতি হতো। তাঁর মৃত্যুর ধরন প্রমাণ করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈরী পরিবেশেও কারও ওপর আক্রমণ পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করেছে। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কের প্রশ্নটিও উঠে আসছে। তবে এটি আল কায়দাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুর্বল করবে বলে মনে হচ্ছে না। ৭১ বছরের জাওয়াহিরি খুব অসুস্থ ছিলেন। কয়েক বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ নিশ্চয়ই অন্যদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে আসছে। এখন তাঁদের মধ্যে কম বয়সী কেউ জাওয়াহিরির স্থলে আল কায়দার নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্ভাব্য কয়েকজন উত্তরসূরি হারালেও এখনও দলটির কয়েকজন যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন।
জাওয়াহিরির পদ গ্রহণের জন্য এখন মোহাম্মদ সালাহ আল-দিন জাইদিন জনপ্রিয়। ৬০ বছর বয়সী এ মিসরীয় সাইফ আল আদেল নামেও অধিক পরিচিত। পশ্চিমা নিরাপত্তা বাহিনীগুলো তাঁকে দক্ষ সংগঠক হিসেবে বিবেচনা করছে। অবশ্য তিনি এখন ইরানে, যার ভ্রমণের কোনো সামর্থ্য নেই এবং তাঁর সব যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সম্ভাব্য উত্তরাধিকারদের মধ্যে আবদ আল-রহমান আল-মাগরিবির নামও রয়েছে। তিনি আল কায়দার মিডিয়া কর্মসূচির পরিচালক। রয়েছে সিরিয়াভিত্তিক আবু আল-ওয়ালিদ আল-ফালাস্তিনির নামও। তাছাড়া স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত কিছু নেতাও এ তালিকায় রয়েছেন। যে-ই জাওয়াহিরির স্থলে আসুন, তাঁর কৌশলগত সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যদিও আল কায়দা স্থানীয় শাখাগুলোর অভিনব ক্ষমতায়নের জন্য পরিচিত ছিল, তার পরও ওপরের পদধারীদের হাতেই মূল ক্ষমতা। আল কায়দায় অনুগত থাকার শপথ গ্রুপের কাছে নয়, ব্যক্তির হাতেই নিতে হয়। এটি অন্যতম বিষয়, যে কারণে আল কায়দার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ওসামা বিন লাদেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অগ্রাহ্য করে পশ্চিমা শত্রুদের হামলার কৌশল গ্রহণ করেন। এমনটি হয়েছে বলেই ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নাইন-ইলেভেন হামলা হয়েছে। যে হামলায় প্রায় ৩০০০ মানুষ প্রাণ হারান।
২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর হাতে ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আয়মান
আরও পড়ুন :
সম্পাদকীয় বাংলাদেশ প্রতিদিন : পণ্যমূল্য আরও বাড়বে, পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি
আল-জাওয়াহিরি আল কায়দার নেতা হন। নেতা হয়েই তিনি আল কায়দাকে দূরবর্তী টার্গেটে হামলার নীতি থেকে বের করে আনেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে বিপরীতমুখী ক্ষতি বেশি হয়। ওসামা বিন লাদেন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধনের জন্য তেলের ট্যাঙ্কারে হামলার পরিকল্পনা করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু জাওয়াহিরি তাঁর সেই পরিকল্পনার পটভূমি বাতিল করে দেন। এর পরিবর্তে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে মনোযোগ দেন। ওই সব গ্রুপের সহায়তায় তাঁদের কর্মকাণ্ড প্রসারের প্রচেষ্টা চালান।
জাওয়াহিরির এ প্রচেষ্টা সব সময় ভালো ফল বয়ে আনেনি। তাঁর ১১ বছরের দায়িত্ব পালনকালে আল কায়দা ইরাক ও সিরিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের উত্থান ঘটে। আইএস ইরাক ও সিরিয়ায় নতুন ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে। সে কারণে এ দুই দেশে আল কায়দার প্রভাব কমে যায়। যদিও তারা ইয়েমেনে কিছু সফলতা পায়। সেটাও পশ্চিমারা ওই অঞ্চলের জন্য ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখে। ফলে সেখানেও তাদের গল্প ব্যর্থতার।
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে জাওয়াহিরির কচ্ছপগতি আইএসের দ্রুতগামী খরগোশকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। আল কায়দা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ সাহারায় তার উপস্থিতি বাড়াতে সক্ষম হয়। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অপর অংশগুলোতে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাওয়াহিরি ব্যক্তিগতভাবে সোমালিয়ার কট্টর আন্দোলন আল শাবাবের সঙ্গে সম্পর্ক গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এ সিদ্ধান্তের ফলে আল কায়দা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এতে করে আল কায়দার কেন্দ্রীয় তহবিলে লাখ লাখ ডলার যোগ করতে সক্ষম হয়। জাওয়াহিরি একই সঙ্গে তালেবানের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন। তিনি আফগানিস্তানের কাবুলের একটি বাড়িতে ড্রোন থেকে ছোড়া দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন। আল কায়দার প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি তখন ওই বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলা হয়, সেটি ছিল কট্টর এক তালেবান নেতার সহযোগীর বাড়ির অন্তর্গত। মার্কিন ড্রোন থেকে ছোড়া হেলফায়ারে তিনি নিহত হলেও অন্য কেউ হতাহত হননি। তবে ওই বাড়ির একটি জানালা উড়ে গেলও ভবনের অন্য তলার জানালাসহ বাকি অংশের কিছুই হয়নি।
এখন প্রশ্ন হলো, আল কায়দা পরিচালনায় নতুন নেতার কৌশল কী হবে। যেই আল কায়দার প্রধান হিসেবে আসুক, তাঁর সামনে বহুমুখী পথ খোলা রয়েছে। তবে কোনো পথই সহজ নয়। তাঁকে তৎপর হয়ে সম্ভাব্য লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হবে। নতুন নেতাকে তালেবানের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। একই সঙ্গে নেতার অধীনদের কী করা উচিত, সে বিষয়েও স্পষ্ট পথরেখা তৈরি করতে হবে। দীর্ঘ দূরত্বে পশ্চিমাদের ওপর হামলা বাস্তবে সম্ভব হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত প্রতিরক্ষার মাধ্যমে ওই সব হামলা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। আল কায়দা হয়তো এক দশক ধরে এমন তাৎপর্যপূর্ণ হামলা পরিচালনা করেনি, তার পরও বিশ্নেষকরা বিশ্বাস করেন, সংগঠনটি চাইলে এমন হামলা করার জন্য বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
সদস্য দেশগুলোর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে করা জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, আল কায়দা লন্ডন, প্যারিস কিংবা ওয়াশিংটন থেকে দূরবর্তী স্থানে অস্থিরতা ও সহিংসতা পরিচালনার কারণে সফল হয়েছে। প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলছে, এসব জায়গার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আইএস, আল কায়দা কিংবা সংশ্নিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা চলতে থাকবে।
জেসন বার্ক: গার্ডিয়ানের সাংবাদিক; গার্ডিয়ান ডটকম থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক