৬৫ শিশু হাসিমুখে বাড়ি ফিরল, ২৫ দম্পতির জোড়া লাগল সংসার

১২ বছর পর আদালতের উদ্যোগে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে রশিদ ও হাসনা দম্পতির সংসার। বুধবার সুনামগঞ্জের আদালত প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

বিয়ের ১০ বছর পর সমস্যা শুরু। একপর্যায়ে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করেন স্ত্রী। পরে পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী চলে যান বাবার বাড়িতে। ১২ বছর পর আদালতের উদ্যোগে মামলাটি আপসে নিষ্পত্তি হয়। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় রশিদ মিয়া (৪৮) ও হাসনা বেগমের (৪২) সংসার। শুধু রশিদ–হাসনা দম্পতি নন, আজ বুধবার সুনামগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেনের উদ্যোগে আরও ২৪ দম্পতির সংসার জোড়া লেগেছে। আদালত থেকে ফুল হাতে তাঁরা সংসারে ফিরেছেন।

বিচারক মো. জাকির হোসেন এই ২৫টি মামলার পাশাপাশি আজ আরও ৫২টি মামলায় ব্যতিক্রমী রায় দিয়েছেন। ওই ৫২টি মামলায় ৬৫ শিশুকে সংশোধনাগারে না পাঠিয়ে ৬ শর্তে পরিবারে ১ বছরের জন্য প্রবেশনে দিয়েছেন। জাতীয় পতাকা, ফুল, ডায়েরি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই হাতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে শিশুরা।

এবারই প্রথম নয়, এর আগে আরও ৪ দফায় বিচারক মো. জাকির হোসেন ১৪৫ মামলায় ২০০ শিশুকে প্রবেশনে দিয়েছেন। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা ২২৫টি মামলার অভিযোগ আপসে নিষ্পত্তি করে ২২৫ দম্পতির সংসার জোড়া লাগিয়েছেন। এ নিয়ে ‘কারাগারে নয়, জাতীয় পতাকা ও ফুল হাতে বাড়ি ফিরল ৭০ শিশু’ ও ‘এক দিনে ৪৭ মামলার রায়, ফুল হাতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন ৪৬ দম্পতি’ শিরোনামে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

মামলাগুলোর সংক্ষিপ্ত এজাহার সূত্রে জানা গেছে, যৌতুক, নির্যাতনসহ ছোটখাটো পারিবারিক সমস্যার কারণে বিভিন্ন সময়ে আদালতে মামলা করেছিলেন ওই ২৫ নারী। অনেকে স্বামীর সংসার ছেড়ে স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আদালতের বিচারক দুই পক্ষের বক্তব্য ও মতামত নিয়েই তাঁদের ‘ভাঙা’ সংসার জোড়া লাগানোর উদ্যোগ নেন। এতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরাও সহযোগিতা করেন।

সুনামগঞ্জে ৫২টি মামলায় ৬৫ জন শিশু–কিশোরকে বিভিন্ন শর্তে কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশনে বাড়িতে পাঠিয়েছেন আদালত

সুনামগঞ্জে ৫২টি মামলায় ৬৫ জন শিশু–কিশোরকে বিভিন্ন শর্তে কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশনে বাড়িতে পাঠিয়েছেন আদালতছবি: প্রথম আলো

পৌর শহরের পূর্ব সুলতানপুর গ্রামের রিপন মিয়া (২৬) ও পিয়ালি বেগমের চার বছর আগে বিয়ে হয়। তাঁদের দুই বছরের একটি মেয়েও আছে। সাত মাস আগে নির্যাতনের অভিযোগে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন পিয়ালি। এরপর একাধিকবার বসেও মিটমাট হয়নি। আদালতের উদ্যোগে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে।

পিয়ালি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাইন (স্বামী) খইছইন আর ঝামেলা করতা না। এর লাগি শেষ করছি।’ রিপন মিয়া বলেন, ‘আমি এখন বুঝছি, ভুল করছিলাম।’ পাশে থাকা রিপনের শ্বশুর মুখলেছ মিয়া বলেন, ‘আমরা তো চাই, তারা মিলমিশ কইরা থাকত। এখন যখন কোর্টে শেষ অইছে, আশা করি, আর কোনো সমস্যা অইত না।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নান্টু রায় বলেন, মামলাগুলো নিষ্পত্তির আগে একাধিকবার দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁদের সম্মতিতেই আপস করা হয়। মামলা নিষ্পত্তির শর্তে বলা আছে, স্বামী-স্ত্রী–সন্তানসহ স্বজনদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা, স্বামী-স্ত্রী উভয়কে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, মনোমালিন্য–বিরোধ দেখা দিলে নিজেরা আলাপ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান করা, স্ত্রীকে নির্যাতন না করা, যৌতুক না চাওয়া।

একই দিনে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০ আইনে ৬৫ শিশুকে প্রবেশনে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন শিশু আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হাসান মাহবুব। মামলাগুলো করার সময় শিশুদের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মারামারি ও ছোটখাটো চুরির। ছয় শর্তে তাদের প্রবেশনে দেওয়া হয়েছে। শর্তগুলো হলো—মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা ও আদালত থেকে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইটি পড়া; হাঁস-মুরগি বা গবাদিপশু পালন, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ বা মুঠোফোন সার্ভিসিংয়ের যেকোনো একটি বিষয়ে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নেওয়া; প্রতিদিন অন্তত দুটি ভালো কাজ করা ও ডায়েরিতে লিখে রাখা; কমপক্ষে ২০টি গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা; ধর্ম পালন ও মা–বাবার আদেশ মেনে চলা এবং মাদক ও অপরাধ থেকে দূরে থাকা।

আদালতের বিচারকের উদ্যোগে আপসে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় সন্তানকে নিয়ে নিজ সংসারে ফিরেছেন সিফাত-খালেদা দম্পতি। বুধবার সুনামগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে

আদালতের বিচারকের উদ্যোগে আপসে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় সন্তানকে নিয়ে নিজ সংসারে ফিরেছেন সিফাত-খালেদা দম্পতি। বুধবার সুনামগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, মামলা ও সাম্প্রতিক বন্যায় শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ছোটখাটো অভিযোগে শিশুদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এতে তাদের শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। তাই শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, জীবনের শুরুতেই শাস্তি না দেওয়া, সংশোধনাগারে আটক অন্যান্য অপরাধীদের থেকে দূরে রাখা ও সংশোধানগারের ওপর চাপ কমাতে আদালত এ রায় দিয়েছেন।

রবিনের বাড়ি শান্তিগঞ্জ উপজেলার উফতিরপাড় গ্রামে। পরিবারের সঙ্গে থাকেন সিলেটে। পড়েন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৮ সালে বাড়িতে একটি মারমারির মামলায় অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও আসামি করা হয়। এর পর থেকে তিনি নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতেন। এতে তাঁর পড়াশোনায় ক্ষতি হতো। আজ তাঁকেও প্রবেশনে দিয়েছেন আদালত। রবিনের বাবা আমির আলী জানান, ঘটনার সময় রবিন বাড়িতে ছিলেন না। তবু তাঁকে আসামি করা হয়। রায় হবে শুনে ভয়ে ছিলেন। তাঁকে পরিবারে দেওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন।

জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা শাহ মো. শফিউর রহমান জানান, প্রবেশনকালে শিশুরা শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন করছে কি না, তা তত্ত্বাবধান করবেন তিনি। অভিভাকের দায়িত্ব, এসব শর্ত পালনে সহযোগিতা করা, পাশে থাকা।

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও একই আদালতের বিচারক বেশকিছু মামলায় শিশুদের প্রবেশনে দিয়েছেন। অনেক দম্পতির সংসার ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এসব রায় সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments