রাঙামাটি শহরের বনরূপা সমতাঘাটে মৌসুমি ফলের সমাহার। নৌকা ভর্তি করে নানা রকম ফল নিয়ে এসেছেন বাগানিরা।
আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে পাহাড়ের তিন জেলায়, যা সারা দেশের উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫%।
খাগড়াছড়ির তরুণ বিপুল ত্রিপুরা পাঁচ একর পাহাড়ি জমিতে আমের বাগান করেন ২০১৭ সালে। ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে লাগান ৫০০টি আম্রপালি আমের চারা। দুই বছরের মাথায় ফলন আসা শুরু করে। শুরুতে লাখ টাকার আম বিক্রি করেন। এখন প্রতি মাসে গড়ে তাঁর বিক্রি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা।
বিপুল ত্রিপুরা স্নাতক শেষ করে চাকরি আশায় না থেকে হয়েছেন বাগানি। পাশাপাশি করছেন ফলের ব্যবসাও। বিপুলের মতো ছোট ছোট কৃষি উদ্যোগে ফলভান্ডার হয়ে উঠছে তিন পার্বত্য জেলা—রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। তিন জেলায় ৩৮ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা ফল চাষে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের হাত ধরে পাহাড়ি এলাকায় আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন আসে এই তিন পার্বত্য জেলা থেকে। পাহাড়ের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮১ শতাংশই ছয়টি ফল—আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও কমলা। এই ছয়টি ফল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৪ টন উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসব ফল ছাড়াও এখন ড্রাগন, কাজুবাদাম, জলপাই, আপেল কুলসহ ৩৮টি ফল উৎপাদিত হয়।
তিন জেলার ফলচাষি, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তাদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির কল্যাণে জুমচাষ ছেড়ে স্থায়ী বাগান করার প্রবণতা ও বিপণন আগের চেয়ে সহজ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল চাষ বাড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষিত উদ্যমী তরুণেরা এই খাতে আসায় নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন :
ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হারে সর্বোচ্চ রেকর্ড বাংলাদেশের
বিদেশে কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা, দেশে ফিরে গড়েছেন মাছ ধরার টোপ ও চার তৈরির কারখানা
জাতীয়ভাবে পরিচিত হাড়িভাঙ্গা আম বিদেশে রপ্তানির প্রস্তুতি
উৎপাদন বাড়ছে
দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হতো না। ২০০৪ সাল থেকে মূলত বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ফলবাগানের সংখ্যা। পাহাড়ি জমিও ফল চাষের আওতায় আসতে থাকে। ২০১৭ সালে প্রায় ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টন ফল উৎপাদিত হয়। চার বছরের মাথায় উৎপাদন ১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টনে। ফল চাষে জমির পরিমাণ ৯৯ হাজার ৬৬৯ হেক্টর।
তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে বেশি ফল উৎপাদিত হয় বান্দরবান জেলায়। গত বছর সাড়ে আট লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে এই জেলায়। ফল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান রাঙামাটির, ছয় লাখ টন। আর খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত হয় সাড়ে তিন লাখ টন। এই তিন জেলার ফলের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রাশীদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ের মাটি এবং আবহাওয়া আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও মাল্টা চাষের উপযোগী। প্রতিবছর তিন পার্বত্য জেলায় গড়ে ১০ শতাংশের বেশি এসব ফলদ বাগান বাড়ছে। তা ছাড়া বসতঘরের আশপাশেও অনেকে বিশেষ করে আম, মাল্টা ও কলাগাছ লাগাচ্ছেন। বাগান করে অনেক কৃষক অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছেন।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮১ শতাংশই ছয়টি ফল—আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও কমলা। এই ছয়টি ফল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৪ টন উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসব ফল ছাড়াও এখন ড্রাগন, কাজুবাদাম, জলপাই, আপেল কুলসহ ৩৮টি ফল উৎপাদিত হয়।
তোয়ে ম্রোর পথ ধরে
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের ফল চাষি তোয়ো ম্রোর পরিচিতি এখন দেশজোড়া। পেয়েছেন প্রথম আলো ও আরটিভি কৃষি পুরস্কার। রেডলেডি পেঁপে চাষ দিয়ে বাগান শুরু করেছিলেন তিনি। এখন প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার আম, আপেলকুল, ড্রাগন ফল বিক্রি করেন তিনি।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বমরা আগে থেকেই ফল চাষ করেন। অন্যরা মূলত পার্বত্য চুক্তির পর এই কাজে যুক্ত হন। ২০০৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে যাঁরা ফল বাগান শুরু করেন, তাঁদের অন্যতম তোয়ে ম্রো। সফল এই ফলচাষি প্রথম আলোকে বলেন, আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, পেঁপে, কমলাবাগানে শুরু হলেও এখন ফলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। এ অঞ্চলের ফল যাচ্ছে সারা দেশে।
তোয়ো ম্রোর পথ ধরে অনেকেই এখন ফল ব্যবসায় নেমেছেন। খাগড়াছড়ির উদ্যোক্তা বিপুল ত্রিপুরা বললেন, অনলাইনে বিপণন শুরু হওয়ায় অনেক ফল চাষি এখন নিজেই নিজের উৎপাদিত ফল সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন।
তিন জেলার কৃষি বিভাগের তথ্য, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা হিসাবে তিন জেলায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মধ্যে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ মানুষ ফল উৎপাদনের নির্ভরশীল।
পাহাড়ি ফলবাগানিরা বলছেন, জুমচাষে আগের মতো ফলন হয় না। তিন-চার মাসের খোরাকও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ফল উৎপাদন করলেই নগদ টাকা পাওয়া যায়।
চিম্বুকপাহাড়ের বাগানি পারিং ম্রো বলেছেন, বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের চিম্বুকপাহাড় ও থানচি পর্যন্ত ৭০-৮০ শতাংশ পরিবারই মিশ্র ফল ও সবজি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। ১৪-১৫ বছর আগের দরিদ্র জুমচাষিদের জীবন বদলে দিয়েছে ফলবাগান ও সবজি চাষ।
সমন্বিত টোলব্যবস্থা নেই
তিন পার্বত্য জেলায় একজন ফলচাষিকে ফল পরিবহনে জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে টোল (মাশুল) দিতে হয়। বান্দরবানের ফলবাহী পাঁচ টনের প্রতিটি গাড়িকে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদকে টোল দিতে হয় তিন হাজার টাকা। ছোট গাড়ি থেকে তোলা হয় দুই হাজার টাকা। অপর দিকে খাগড়াছড়িতে টোল দিতে হয় জেলা পরিষদ, মাটিরাঙ্গা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভা এবং বাজার ফান্ডকে। সব মিলিয়ে করা দাঁড়ায় ছোট ট্রাকে তিন হাজার ও বড় ট্রাকে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। রাঙামাটিতে ফলের গাড়ি থেকে পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ টোল আদায় করে। এতে ছোট ট্রাক থেকে দেড় হাজার ও বড় ট্রাক থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা আদায় করা হয়।
বাগানি ও ফল ব্যবসায়ীরা চান একটি সমন্বিত টোলব্যবস্থা, যা তিন জেলায় একই হারে একটি প্রতিষ্ঠান আদায় করবে। এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামের ফল উৎপাদন নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করা ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দূরত্বের কারণে পার্বত্য জেলার ফল সারা দেশের বাজারে ঠিকভাবে প্রবেশ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি টোল ও অদৃশ্যমান চাঁদার মতো বাধা দূর করতে হবে।