বিদেশে কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা, দেশে ফিরে গড়েছেন মাছ ধরার টোপ ও চার তৈরির কারখানা

নিউজিল্যান্ডে কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তবে দেশে ফিরে গড়েছেন টোপ ও চার তৈরির কারখানা। এখন বিদেশেও যাচ্ছে তাঁর কারখানার পণ্য। রাজশাহীর এইচ আতাউর রহমান ওরফে আকিব নিজেও শখের শিকারি। তাঁর মাছ ধরার দর্শনটাও আলাদা। এ বিষয়ে লিখেছেন ‘ছিপ বড়শি’ নামে বই। তাঁর গল্প শুনেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

নিউজিল্যান্ডের ফিলিং স্টেশনগুলো দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। এসব ফিলিং স্টেশনে পেট্রল, তেল, মবিলের পাশাপাশি কুকুর-বিড়ালের খাবার যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় মাছ ধরার উপকরণ। আকিব তখন ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে ইনফরমেশন সিস্টেমস বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। ছোটবেলার মাছ ধরার শখটা ভিনদেশে এসে নতুন করে পেয়ে বসল। সময় পেলেই মাছ ধরতে ছুটে যান নিউজিল্যান্ডের নানা জায়গায়। সহজেই কিনতে পারেন মাছ ধরার প্রয়োজনীয় সব উপকরণ।

স্নাতকোত্তর শেষ করার আগেই চাকরিতে ঢুকে পড়েন আকিব। মাছ শিকারও চলতে থাকে। ২০১৭ সালে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো । অসুস্থ বাবার পাশে থাকতে দেশে ফিরে এলেন আকিব, চলে এলেন রাজশাহী।

দেশে ফিরে মাছ ধরতে গিয়ে কিছুটা ধাক্কা খেলেন আকিব। মাছ ধরার অনুমোদিত কোনো টোপ-চার নেই। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় পিঁপড়ার ডিমের সঙ্গে পাউরুটি মেখে টোপ বানানো ও হাতে বানানো মিষ্টি চার পাওয়া যায়। এসব দিয়েই মাছ শিকার করতে লাগলেন আকিব। মাছ শিকার বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে আপলোড করেন। অনেক অনুসারীও জুটে যায়। প্রতিদিন তাঁর ভিডিও দেখেন শখের শিকারিরা। মন্তব্য করেন, নানা পরামর্শও চান আকিবের কাছে।

আকিবের কারখানার টোপ ও চার বিদেশেও যাচ্ছে

আকিবের কারখানার টোপ ও চার বিদেশেও যাচ্ছে ছবি: সংগৃহীত

মানুষের আগ্রহ দেখে আকিব চিন্তা করলেন এভাবে নির্বিচারে টোপের জন্য পিঁপড়ার ডিম ব্যবহার করলে তো প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিকল্প ভাবতে শুরু করেন আকিব। নিউজিল্যান্ডে ছয় বছর ছিলেন আকিব। সেখানেই মাছ শিকার করতে গিয়ে বুঝেছেন মাছের বুদ্ধি কম। ব্যথা অনুভব করে কম। পরিপাকতন্ত্র সুগঠিত নয়। সহজে হজম হয় এমন জিনিসের প্রতি মাছের আকর্ষণ। টোপ ও চার বানানোর সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখেন। পানি দূষণ হবে না, মাছের শারীরিক কোনো সমস্যা হবে না, জিনিসটা হবে পরিবেশবান্ধব—এসবও বিবেচনায় থাকে। একপর্যায়ে বাড়িতেই তৈরি করেন টোপ ও চার তৈরির কারখানা। যা নিজে ব্যবহার করলেন। দিনে দিনে প্রচার পেল পরিচিতদের কাছে। বড় হতে থাকল তাঁর কারখানার পরিসর। আর এখন তো মাছের প্রকার ভেদে এবং মাছের সাইজ অনুযায়ী ১৪ ধরনের টোপ-চার তৈরি করেন আকিব।

আরও পড়ুন :

বাংলাদেশে উৎপাদিত চা যাচ্ছে ২৩ দেশে, দিন দিন বাড়ছে আয়

রাবাব ফাতিমা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেলেন

৫৫ বছরের বেলায়েত শেখ এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন

স্কুল–কলেজের পড়াশোনা ঢাকায় করেছেন আকিব। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে উচ্চমাধ্যমিক। এরপর দেশের বাইরে চলে যান। কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন মেক্সিকোর ইউনিভার্সিদাদ ডেল গলফো দে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপর ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে স্নাতকোত্তর। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আকিব এখন ব্যবসা করছেন টোপ ও চার নিয়েই! এটাই তাঁর পেশা।

আকিব নিজেও মাছ শিকারি, তবে তাঁর আছে আলাদা দর্শন

আকিব নিজেও মাছ শিকারি, তবে তাঁর আছে আলাদা দর্শন ছবি: সংগৃহীত

টোপ-চার যায় বিদেশে

রাজশাহীতে আকিবদের বাসার তৃতীয় তলায় তাঁর কারখানা। পাঁচটি যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে টপ ও চার। বড় বড় ড্রামে কাঁচামাল ভরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মেশিনে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে বেরিয়ে আসছে। আরেকটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে বোতলে মাছ ধরার তেল ভরা হচ্ছে। এসব কাজ করছেন ১৫ জন প্রশিক্ষিত কর্মী। প্রতিদিন সাড়ে তিন মেট্রিক টন টোপ ও চার উৎপাদন করেন তাঁরা।

আকিব জানালেন, আগুনজল নামের একটি ফেরোমন স্প্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু তাঁর কারখানাতেই তৈরি হয়। বড় মাছকে আকৃষ্ট করার জন্য টোপে এই আগুনজল স্প্রে করা হয়। এ ছাড়া আকিবের কিছু জনপ্রিয় টোপ ও চার রয়েছে। এগুলো হলো কারেন্ট চার, তেল চার, পদ্ম মধু, মহুয়া চার, জাফরানি ছাতু, রেডি টোপ, মহুয়া পুডিং, কস্তুরি মসলা, বিরিয়ানি পাউডার ও ফিরনি টোপ। এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে আকিবের টোপ ও চার। ভারত ও নিউজিল্যান্ডে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

ভারতেও গিয়েছিলেন মাছ শিকার করতে

ভারতেও গিয়েছিলেন মাছ শিকার করতে ছবি: সংগৃহীত

মাছ ধরাতেও আছে নীতিনৈতিকতা

নিউজিল্যান্ডে নিয়ম মেনে মাছ শিকার করতে হয়। এসবের নিয়মের মধ্যে আছে মাছের আকারের বিষয়টিও। মাছের আকার ৯ থেকে ৩০ সেন্টিমিটারের মধ্যে হতে হয়। সর্বোচ্চ আকারের ৭টির বেশি মাছ শিকার করা যায় না। আকিব তাঁর এমন নানা অভিজ্ঞতা শিকারিদের জানাতে ভিডিও বানান। সেসব তুলে দেন তাঁর ইউটিউবে। মাছের স্বাস্থ্য, নদীর পানি ও পরিবেশ বিষয়ে শৌখিন মাছশিকারিদের সচেতন করেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘প্রিমিটিভ ফিশিং বাই আকিব’। সাবস্ক্রাইবার ১ লাখ ৮৮ হাজার।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। ইন্টারন্যাশনাল গেম ফিশ অ্যাসোসিয়েশনের তিনি সদস্য। পদ্মায় ১২ কেজি ৭৭০ গ্রাম ওজনের কাতলা মাছ ধরার জন্য এই সংস্থা তাঁকে ‘ক্যাচ’ সার্টিফিকেট দিয়েছে। আকিব জানালেন, দেশে তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্যাচ সার্টিফিকেটধারী মৎস্যশিকারি।

মহাশোল ধরতে ভারত

মহাশোল বাংলাদেশে মহাবিপন্ন মাছ। ২০১২ সালের বন্য প্রাণী আইন দ্বারা সংরক্ষিত। এই মহাশোল ধরতে ভারতে গিয়েছিলেন আকিব। ভারতের উত্তরাখন্ডের বিধায়ক প্রয়াত সুরেন্দ্র সিং জিনা মহাশোল সংরক্ষণের জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব করে মহাকালী নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকা ইজারা নিয়ে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেন। সেখানে মহাশোল সংরক্ষণ প্রকল্প করা হয়েছে। জায়গাটির নাম পঞ্চেশ্বর। এক পাশে নেপাল আরেক পাশে ভারত। মাঝখান দিয়ে গেছে মহাকালী। গত এপ্রিলে সেখানে গিয়ে টানা তিন দিনের চেষ্টায় মহাশোল শিকার করেন আকিব। ধরে তখনই তা ছেড়ে দেন। তিনি মহাশোল সংরক্ষণ প্রকল্পের একজন পৃষ্ঠপোষক। প্রতিবছর এই তহবিলে একটি বিশেষ পরিমাণ অর্থ দেবেন, এই মাছ সংরক্ষণে কারিগরি বিষয়ে সহযোগিতা করবেন। আকিব বলেন, ‘মাছটি সংরক্ষণের উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পেরে ভালো লাগছে। আগামী মাসে আবার সেখানে যাব।’

এক টাকায় মাছ শিকার

২০১৮ সালে এক টাকার টিকিটে মাছ ধরার আন্দোলন শুরু করেছেন আকিব। নিজের পুকুর থেকেই এর যাত্রা শুরু করেন। টোপ-চার নিজের, যাতায়াত, খাওয়াদাওয়া ব্যবস্থার জন্য নেওয়া হয় ৫০০ টাকা। আর মাছ ধরার টিকিট হচ্ছে এক টাকা। এ থেকে যে অর্থ বেঁচে যায় তা দিয়ে পোনা কিনে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীতে আয়োজন করেছেন ১০-১২টি ইভেন্ট। সর্বোচ্চ ১৫০ জন শিকারি পেয়েছিলেন ঢাকায়। এ ক্ষেত্রে পুকুরমালিককে বোঝানো হয়, বাজারে যে দামে মাছ বিক্রি হয়, বড়শিতে ওঠার পর কোনো মাছ আহত হলে তার চেয়ে ১০ টাকা বেশি দিয়ে যিনি ধরেছেন তিনি কিনে নেবেন। এই আন্দোলনের মূল কথা হচ্ছে, ‘মাছ ধরব তারপর ছেড়ে দেব। আহত হলে কিনে নেব।’

ছাড়ার জন্য মাছ শিকার

আকিব মাছ শিকার করেন, ছেড়েও দেন। তাঁর দর্শন, মাছ শিকার মানে নিজেকে সময় দেওয়া। বিষয়টি তিনি খোলসা করলেন এভাবে, মাছে ভাতে বাঙালি, প্রবাদটি আমাদের আত্মপরিচয় বহন করে। অথচ জেলে জাইল্যা, মাছুয়া, মাইছ্যাল শব্দগুলো আমরা কীভাবে গ্রহণ করি—যেমন মাছের আঁশটে গন্ধটা। নিজের উপলব্ধির জায়গাটা একটু পরিবর্তন করে যখন মৎস্য শিকার বা আরও পেছনে ভিক্টোরিয়ান আমল থেকে উঠে আসা শব্দ ‘অ্যাংলার’, ‘অ্যাংলিং’ বা হালের ‘ফিশিং’ শব্দের কাছে আসি, তখন বুকটা খানিক ফুল ওঠে। আকিব বলেন, ‘কিছু নয়, শুধু বোধের জায়গাটায় একটু ঘষা দেওয়া। যেমন নিজেকে সময় দেওয়া বলতে আমরা কে কী বুঝি? আদৌ কি নিজেকে সময় দেওয়ার সময় সত্যিই কখনো হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে মাছ শিকারের মাধ্যমেই সেটা হয়ে উঠতে পারে। আর ইতিবাচকভাবে মাছশিকারি বলতে তাঁকেই বোঝায়, যিনি মাছ ধরে ছেড়ে দেন। মাছ খাবেন যত খুশি বাজার থেকে কিনে।’

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তালগাছ লাগিয়ে, রাস্তা বানিয়ে অনন্য নজির গড়েছেন যশোর কেশবপুরের মিজানুর রহমান - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]

এসএসসি পরীক্ষা ২০২২ এর রুটিন প্রকাশ - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]

বাংলাদেশি রোভার এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করল - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]

মাত্র ৩০ দিনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলুন - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]

পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন নতুন ফলভান্ডার - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]

মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ চারে - Ajker Valo Khobor
2 years ago

[…] […]