বাংলাদেশের ডা. শেহলীনা আহমেদ পেলেন “অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার” খেতাব

ডা. শেহলীনা আহমেদ ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শক। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা উদ্যোগের সঙ্গে তিনি যুক্ত আছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত মাসে পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের রানির বেসামরিক খেতাব ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’।

চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডা. শেহলীনা আহমেদ। চাকরি করতে গিয়ে জীবনে যা করা হয়ে ওঠেনি, অথচ করা উচিত ছিল, এখন তিনি সেসব করবেন। তাঁর সেই তালিকায় যেমন আছে ভ্রমণ, তেমনি আছে দুই নাতি, ছেলে, স্বামীকে সময় দেওয়া। যে বইটি এত দিন পড়া হয়ে ওঠেনি, তা–ও হাতে তুলে নেবেন। তবে মনে করিয়ে দিলেন, চাকরি ছাড়লেও কাজ ছাড়ছেন না। তবে কাজ করবেন নিজের মতো।

শেহলীনা আহমেদ ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনে স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ পরামর্শক। ১৩ বছর ধরে তিনি যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করছেন। এই পদে থাকার সময় দাতাদের মঞ্চ ‘ডোনার কনসোর্টিয়াম’-এর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই শুধু নয়, দেশের জনস্বাস্থ্যবিদদের কাছেও অতিপরিচিত এক নাম শেহলীনা।

আরও পড়ুন :

★★এ বছর সাত বাংলাদেশী স্থান পেল ‘ফোর্বস ৩০ আন্ডার ৩০ এশিয়া ২০২২’ এ

★★নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় বাংলাদেশ

★★ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে কাজকে ভালবেসে অবশেষে গুগলে যোগ দিলেন সিলেটের নাফিউল আদনান

ডা. শেহলীনা বলছিলেন, ‘একসময় দিনে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করেছি। অফিসের কাজ বাসায় করেছি। ছেলেদের দিকে, স্বামীর দিকে মনোযোগ থাকলেও সময় দিতে পারিনি। সংসার সামলেছেন আমার স্বামী।’ তবে এও মনে করিয়ে দিলেন, ব্যস্ততার মধ্যেও রাতে এক টেবিলে পরিবারের সবার সঙ্গে খাওয়ার রীতি দীর্ঘদিন চালু ছিল। সেখানেই ছেলেদের পড়াশোনার খবর নিতেন। প্রয়োজনে দেখিয়ে দিতেন কোনো বিষয়। তাঁর দুই ছেলে এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।

শেহলীনা আহমেদের পৈতৃক বাড়ি ফেনী হলেও জন্ম ঢাকায়। বাবা গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুদ্দিন আহমেদ বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে পাকিস্তানে কেটেছে শেহলীনের স্কুলজীবন। স্বাধীনতার পর হলি ক্রস কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এমবিবিএস পাস করার পর বিয়ে। স্বামী সৈয়দ নাসরুল্লাহও পেশায় চিকিৎসক। ১৯৮৫ সালে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ইরান চলে যান। সেখানেই দুই ছেলের জন্ম। ইরানে দুই ছেলের পড়াশোনার অসুবিধা হচ্ছিল। ছেলেদের পড়াশোনার কথা বিবেচনা করেই ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে আসেন।

শেহলীনা আহমেদ বলেন, ‘দেশে ফিরে নিপসম থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপর এমপিএইচ ডিগ্রি নিই। প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে। ওই কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘোরা শুরু।’ এরই মধ্যে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

দুর্গম এলাকায় কী করে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই অভিজ্ঞতা হয় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালে কাজ করার সময়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীদের অদ্ভুত মানসিকতা প্রত্যক্ষ করি। শিশু অসুস্থ হলে বহু পথ পাড়ি দিয়ে শিশুকে নিয়ে মায়েরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। কিন্তু মা নিজে অসুস্থ হলে কাউকে বলতেই চান না, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া তো দূরের কথা।’ ১৯৯৮ সালে সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কমিউনিটি ক্লিনিককে কার্যকর করে তুলতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করে। এতে বড় ভূমিকা ছিল ডা. শেহলীনার।

২০০৫ থেকে ২০০৮–এর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে থাইল্যান্ড চলে যান। ব্যাংকক থেকে ১০টি দেশের কার্যক্রম নজরদারি ও তদারকি করতে তিনি। সেখানে কাজ করার সময় বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিচিত্র উদ্যোগ, দেশগুলোর সরকারের নানা কর্মসূচি বিষয়ে জানার সুযোগ হয় তাঁর।

দেশে ফিরে কিছুদিন কাজ করেন ইউনিসেফে। ২০০৯ সালে যোগ দেন যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিএফআইডিতে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী ডিএফআইডি। স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন এক দশকের বেশি সময়। সে পদে থেকে মিলল ব্রিটিশ রানির স্বীকৃতি।

যুক্তরাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ সম্মাননা দেওয়া হয়। সম্মাননার পাঁচটি শ্রেণি। ডা. শেহলীনা আহমেদকে ‘মেম্বার অব দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (এমবিই)’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কোন কাজের জন্য এ সম্মাননা? শেহলীনা আহমেদ বলেন, ‘মূলত দুটো কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে মিডওয়াইফারি সেবা চালু করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা। দ্বিতীয়ত, করোনা মহামারি মোকাবিলায় দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে পারা।’

গ্রামের মানুষের বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা ডা. শেহলীনার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন এনজিও ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা হেলথ সিস্টেম দৃঢ় করতে একইভাবে বিশেষায়িত মতামত দিয়েছেন। করোনা মহামারির সময় দাতাগোষ্ঠী ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরির কাজ করেছেন। শেহলীনা আহমেদ বলেন, ‘আমি সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে চলে, তা জানি। আমি দাতাদের সংস্কৃতিও বুঝি। তাই নানা ইস্যুতে মধ্যস্থতা করা আমার জন্য সহজ ছিল।’

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
পায়ের পেশিতে হঠাৎ টান পড়লে কী করবেন - Ajker Valo Khobor
3 years ago

[…] […]

রাবাব ফাতিমা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেলেন - Ajker Valo Khobor
3 years ago

[…] […]