চোররে চোর বললে বান্দরের মতো ভেচকি মারে: মির্জা আজম

জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ চত্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা আজম। আজ রোববার দুপুরেছবি: সংগৃহীত

জামালপুর-৩ (মাদারগঞ্জ-মেলান্দহ) আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেছেন, ‘আমার মতো মানুষ যখন কোনো ঘুষখোরের বিরুদ্ধে কথা বলি, যখন ঘুষখোরদের দুর্নীতির কোনো ইতিহাস বলি, তখন দেখা যায় চোরের দল সমিতি বানিয়ে ফেলেছে এবং বিশাল বিশাল সমিতি, অনেক শক্তিশালী সমিতি। সেই সমিতির পক্ষ থেকে আমারে বান্দরের মতো ভেচকি মারে। আজকে চোররে চোর বললে বান্দরের মতো ভেচকি মারে, পত্রিকায় স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দেয়, তারা মানববন্ধন করে, হুমকি দেয়। এমপিগিরি (সাংসদ) থেকে রিজাইন (পদত্যাগ) করার জন্য হুমকি দেয়।’

আজ রোববার দুপুরে জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা আজম বলনে, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা দিতেন, তখন কিন্তু ঘুষখোররা প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। একইভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যখন কথা বলেন, ঘুষখোররা প্রতিবাদ করার সাহস পান না।’

মির্জা আজমের বক্তব্যের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ভাষ্যমতে, দেশের ‘সবচেয়ে মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা বুয়েট–মেডিকেলে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে আসার পর তাঁরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক সমিতি। গত ৩০ জানুয়ারি দেওয়া বিবৃতিতে অবিলম্বে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার এবং দেশের প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের কাছে দুঃখ প্রকাশের জন্য মির্জা আজমের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

প্রতিবাদের মুখে মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি সব চিকিৎসক ও প্রকৌশলীকে নিয়ে ওই কথা বলেননি। সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয় নিয়ে কথা প্রসঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের সমালোচনা করেছেন। তবে ‘চোর’ শব্দটা বলা উচিৎ হয় নি।

আজ জামালপুরে ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া একটি দুর্নীতিবিরোধী ভাষণ তাঁর মুঠোফোনে বাজিয়ে উপস্থিত সবাইকে শোনান মির্জা আজম। এরপর তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এক থেকে দুই মাস আগে তাঁর বক্তৃতায় এই ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে আরেকটা কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, না হলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে, বেতনের টাকায় না পোষালে চাকরি ছেড়ে ভিক্ষা করে খেতে হবে। দুর্নীতি করে খাওয়ার থেকে ভিক্ষা করে খাওয়ার মধ্যে মর্যাদা অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধু যে ভাষায় কথা বলেন, আমাদের নেত্রীও কিন্তু একই ভাষায় কথা বলেন।’

সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে মির্জা আজম বলেন, ‘আমরা কি নেত্রীর এই কথাগুলো প্রচার করি? আমরা মনে করি, নেত্রী কথার কথা কইছে, আমাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। শেখ হাসিনার সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা) যে বক্তৃতা দিল, তার জন্যে আমরা কী করছি? কেউ কিছু করি নাই।’

অনেক ঘুষখোর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে মসজিদে যান। যখন দেখা যাবে ঘুষখোর হিসেবে চিহ্নত হয়ে যাবে, তখন কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজও পড়বে না।

মির্জা আজম, সাংসদ, জামালপুর-৩

মির্জা আজম বলেন, ‘আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করি। শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছে, ঘুষখোরদের চাকরি ছেড়ে, ভিক্ষা করে খাইতে কইছে। এখন আমরা যদি কর্মসূচি দেই, যারা ঘুষখোর, তাদের বাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে দিব—এটা ঘুষখোরের বাড়ি। আমরা যদি কোনো ঘুষখোরের অফিসে স্টিকার মেরে দেই—এটা ঘুষখোরের অফিস। তাহলে দেখবেন ঘুষখোর যত টাকার মালিক হোক, যত শক্তিশালী হক। তাঁরা কিন্তু বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। অনেক ঘুষখোর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে মসজিদে যান। যখন দেখা যাবে ঘুষখোর হিসেবে চিহ্নত হয়ে যাবে, তখন কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজও পড়বে না।’

দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ বা তার একটু কম মানুষ ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ বলে মনে করেন মির্জা আজম। এই অল্পসংখ্যক দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরের বিরুদ্ধে বাকি সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আমার মতো দুই-একজন যখন বলবেন, তখন আমার মতো ভেচকি মারবে। তারা হয়তো জানে না, এই ভেচকিতে মির্জা আজম ভয় পায় না।’

৩০ বছর আগে দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে সংসদে বক্তৃতা করার ইতিহাস তুলে ধরে মির্জা আজম আরও বলেন, ‘বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। তখনো বিএনপির নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা আমাকে খুঁজছে। আমাকে যেখানেই পাবে, সেই জায়গায় মেরে ফেলবে। আমাকে লক্ষ্য করে গুলিও এবং বাসায় হামলাও করা হয়েছে। জাতীয়ভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেইগুলোকেই পরোয়া করি নাই। আমাকে থামাতে পারে নাই।’

শুধু একটিমাত্র শ্রেণি–পেশার মধ্যে ঘুষখোরেরা সীমাবদ্ধ নয় উল্লেখ করে মির্জা আজম বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় দেখি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আসে। যখন একটি স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়, তখনই কিন্তু আমাদের প্রধান শিক্ষক সাহেবদের চরিত্রটা বেরিয়ে আসে। একটি মাদ্রাসায় নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হলেই সুপারের চরিত্র কিন্তু বেরিয়ে আসে।’

মির্জা আজম আরও বলেন, বেসরকারি কলেজে যখন কোনো নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন কিন্তু সেই অধ্যক্ষের চেহারাও বেরিয়ে আসে। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, শুধু তাঁরাই ঘুষ খান না। গ্রামের সালিস বৈঠকেও সালিসদার যারা, তারা ঘুষ খেয়ে বিচার করে থাকে। সমাজের এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন মির্জা আজম।

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments