ইউটিউবে সাড়ে চার কোটি বার দেখা হয়েছে এমন একটি গানের ভাইরাল ভিডিও’র মডেল বাউল সেলিমকে গ্রেফতার করেছে র্যাব যিনি বাংলাদেশে একটি হত্যাকাণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামী এবং আরও দুটি হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত।
দীর্ঘদিন ধরে পলাতক মোঃ হেলাল হোসেন এতদিন বাউল ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিলেন। র্যাবের পক্ষ থেকে তাকে ‘সিরিয়াল কিলার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন
নিজে নামকরা কোন বাউল গায়ক না হলেও ইউটিউবে সাড়ে চার কোটিবার দেখা হয়েছে ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’, এই গানটির ভাইরাল মিউজিক ভিডিওতে একজন মডেল তিনি।
যে ভিডিও’র মাধ্যমে তার চারপাশে পরিচয় সেটি দিয়েই তাকে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও যোগাযোগ উইং-এর পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
মাস ছয়েক আগে এই গানের ভিডিও’র দেখেই হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এই বাউলকে চিহ্নিত করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের একজন সোর্স, এমন তথ্য দিয়েছেন খন্দকার আল মঈন।
তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “আমরা প্রথমত জানতে পারি যে ইউটিউবের এই গানটি নারায়ণগঞ্জের রেল স্টেশনে শুটিং করা হয়েছিল।
“আমরা সেখানে এই অবয়বের মানুষটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। স্থানীয়দের তথ্য ধরে ছয় মাস চেষ্টার পর আমরা গতকাল রাতে তাকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছি।”
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার পর সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে। তাকে আঙুলের ছাপ দিয়ে শনাক্ত করা হয়েছে, বলে জানিয়েছেন মি. মঈন।

কে এই বাউল সেলিম
নাম মোঃ হেলাল হোসেন। বয়স ৪৫ মতো। র্যাবের এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়ার বাসিন্দা তবে দীর্ঘদিন যাবত চট্টগ্রাম, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে মাজার, বন্দর ও রেল স্টেশনে তার বিচরণ ছিল। এসব এলাকায় ফকির সেলিম বা বাউল সেলিম হিসেবে তার পরিচয়।
পেশায় দরিদ্র মুদি দোকানদার ছিলেন। একুশ বছর বয়সেই তিনি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
দু’হাজার এক সালে বগুড়ার একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় আদালত ২০১৫ সালে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এর পর থেকেই তার ফেরারি জীবনের শুরু।
এছাড়া ১৯৯৭ এবং ২০০৬ সালের আরও দুটি হত্যা মামলায় চার্জশীট-ভুক্ত অভিযুক্ত তিনি। ২০১০ সালে একটি চুরি’র মামলায় কারাদণ্ড ভোগ করেন।
তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলাও রয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলায় তার নিজের একটি হাত এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত।
খন্দকার আল মঈন বলেছেন, “বাউল হিসেবে তিনি ছদ্মবেশে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। সে যেহেতু নিজে গান গাইতে পারতো, তাই বাউলের ছদ্মবেশ তার জন্য সুইটেবল হয়েছে, এই ছদ্মবেশে তার জীবিকা নির্বাহ করা সহজ হয়েছে।”
ভাইরাল গানের ভিডিওতে যেভাবে মডেল হলেন
যে গানের ভিডিও থেকে তাকে চিহ্নিত করা হয় সেটি ২০১২ সালে জি সিরিজ থেকে প্রকাশিত ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’। ২০১৬ সালে ইউটিউবে এর মিউজিক ভিডিও প্রকাশিত হয়।
যাতে দেখা যাচ্ছে সাদা থান গায়ে জড়ানো একজন, মাথায় লম্বা চুলে খোঁপা বাধা, খালি পায়ে রেল লাইনের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছেন।
মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ির জন্য তার চেহারা বোঝা যায় না। ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি এক অর্থে প্রকাশ্যেই ছিলেন।
গানটির শিল্পী কিশোর পলাশ বিবিসিকে বলছিলেন, কীভাবে হেলাল হোসেনকে তারা মিউজিক ভিডিওর জন্য নির্বাচিত করেছিলেন।
তিনি জানান, ২০১২ সালে গানটি প্রকাশিত হলেও এটির কোন মিউজিক ভিডিও ছিল না। গানটি জনপ্রিয় ছিল বলে ২০১৬ সালে মিউজিক ভিডিও তৈরির সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
তিনি বলেন, “এটা আশাহত মানুষের গান। যেহেতু ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল, তাই নদী আছে এমন কোথাও আমরা শুটি করতে চাইলাম। ঢাকার আশেপাশে কোথাও হলে ভালো হয় এমন যায়গা। তো আমরা চলে যাই নারায়ণগঞ্জ। আমরা অনস্পট যেসব আশাহত মানুষ পেয়েছি তাদেরকেই শুন করে ভিডিওতে নিয়েছি। কোন পূর্ব পরিচয় ছিল বা কন্ট্রাক্ট করে নেয়া এমন না।”
“সেখানে আমরা যে নৌকা ভাড়া করেছি তার মাঝিকে শুট করেছি। একজন মুচি, হকার, দোকানদার, দিনমজুর শুট করেছি। রেলস্টেশনে যখন একজন মুচিকে শুট করছিলাম, তার পাশেই দেখলাম একজন সাধু টাইপের বাউল পোশাক পরা লোক বসে আছে। আমরা চিন্তা করলাম যে এটা যেহেতু একটা আধ্যাত্মিক টাইপের গান তো একেও নেয়া যেতে পারে। সব মিলিয়ে আধাঘণ্টা সে ক্যামেরার সামনে ছিল। তাকে আমরা কিছু টাকায় দিয়েছিলাম। এই ভাবেই সে আমার ভিডিও’র মডেল।”
কিশোর পলাশ বলছেন, যে গানের মাধ্যমে তার পরিচিতি ও ক্যারিয়ারের উত্থান সেটির সাথে এমন একজনের সংযোগ বিষয়টি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
গানটি যতবার তিনি গাইবেন এবং যারা সেটি শুনবেন এই কথাই বারবার মনে পড়বে ভেবে কষ্টে পাচ্ছেন তিনি।