আমরা যারা নব্বই দশকের তরুণ, দুই নেত্রীর উত্থান ঘটে আমাদের সামনেই। আমরা অনেকেই তাঁদের মিছিলে থেকেছি, তাঁদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিয়েছি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে তাঁদের ত্যাগ, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা দেখেছি। তাই দলমত-নির্বিশেষে কিছুটা হলেও আমাদের ভালোবাসা আর মুগ্ধতা আছে দুই নেত্রীর প্রতি। কারও ক্ষেত্রে কম, কারও ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে, কিন্তু তাঁদের সম্পূর্ণ অশ্রদ্ধা বা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।
এই বোধ থেকে বিভিন্ন সংকটকালে আমরা দুই নেত্রীকে সমর্থন জানাই। যেমন আমি ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার পর প্রতিবাদ জানিয়ে কলাম লিখেছি। এক–এগারোর সময় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে বাধা দেওয়ার সময় এর বিপক্ষে লিখেছি, বলেছি। আবার বিএনপি নেত্রী প্রায় ১০ বছর ধরে যে নিরন্তর শোচনীয় ঘটনার শিকার হচ্ছেন (বাসা থেকে উচ্ছেদ, বিতর্কিত বিচার, কারাকালীন দুর্ভোগ), এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছি। একই মনোভাবের ধারাবাহিকতা হিসেবে খালেদা জিয়ার বর্তমান গুরুতর শারীরিক অবস্থায় অন্য অনেকের মতো বিচলিত বোধ করছি।
তবে এই বিচলিত ভাব শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতির কারণে নয়; এটি সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থেকেও। বেগম জিয়া একজন নারী, বয়োবৃদ্ধ, নানান দুরারোগ্য ব্যাধিতে এখন তাঁর জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে। এমন একজনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর তাগিদ আমাদের দেশের আইনে রয়েছে (যেমন: জামিন প্রদান ও সাজা স্থগিত করাসংক্রান্ত ফৌজদারি আইনের বিধান)। আমাদের সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার স্থাপন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করার যেসব বিধান আছে, তার উৎস মানবিকতা থেকে। উন্নত বিশ্বে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগের জন্য এসব বিধান ব্যবহার করা হয়। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারাও একই মনোভাব পোষণ করতেন, যদিও পরে এসব বিধানের কিছু অপপ্রয়োগ হয়েছে এ দেশে।
বেগম জিয়ার চিকিৎসার এবং এক অর্থে বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের তাগিদ সমাজে রয়েছে। আমরা এ দেশে খুনের দায়ে দণ্ডিত নৃশংস সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেতে দেখেছি। প্রশ্ন উঠেছে, তিনবারের নির্বাচিত একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষার্থে তাঁকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি তাহলে কেন দেওয়া যাবে না?
আইন মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের উদার ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। বেগম জিয়াকে বাসায় রেখে কারাদণ্ড ভোগ করার সিদ্ধান্ত যে মানবিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, তাঁকে চিকিৎসার জন্য অনতিবিলম্বে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্তও সে আলোকে নেওয়া যায়।
এখানে আইনি বাধার কথা বলা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইনে কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে অন্য পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, সুযোগ অবশ্যই আছে। তাঁরা বলছেন, যে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর অধীনে তাঁর সাজা ‘শর্তযুক্ত’ভাবে স্থগিত করা হয়েছে, তা এখন ‘শর্তহীন’ করে দিলেই তিনি বিদেশে যেতে পারেন। এ ছাড়া ৪০১ (৬)-এর অধীনে বিশেষ আদেশের মাধ্যমে তাঁকে বিদেশে পাঠানো যায়। আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকও একটি পত্রিকায় অনুরূপ অভিমত দিয়েছেন।
আইন মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের উদার ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। বেগম জিয়াকে বাসায় রেখে কারাদণ্ড ভোগ করার সিদ্ধান্ত যে মানবিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, তাঁকে চিকিৎসার জন্য অনতিবিলম্বে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্তও সে আলোকে নেওয়া যায়।
২.
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের অন্তরায় হিসেবে দুই নেত্রীর সম্পর্কের জটিলতার কথা আসে। প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলনে নিজেও তাঁর প্রতি খালেদা জিয়ার বিরূপ আচরণের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তবে এসব সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের ক্যানভাস আরও বিশাল। মাত্র বছর কয়েক আগেও আন্দোলন, সংগ্রাম, নির্বাচন, ক্ষমতা—সব আবর্তিত হতো এই দুই নেত্রীকে ঘিরে। তাঁদের মধ্যে বিরোধ, মতভেদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল দেশে ও বিদেশে আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু তাঁরা যে একসঙ্গে মিলেমিশে দুবার (এরশাদবিরোধী ও এক–এগারো সরকারবিরোধী) বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটির দিকে আমাদের দৃষ্টি গেছে কম। বাংলাদেশের বহু বিপর্যয়কালে আমরা সবচেয়ে বেশি আশাবাদী হয়ে উঠতাম তাঁদের মধ্যে কোনো মতৈক্য বা সমঝোতায়।
এটি ঠিক, তাঁদের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময় খালেদা জিয়ার কিছু আচরণ ও সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। ১৫ আগস্ট তাঁর সত্যি জন্মদিন কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হঠাৎ ঘটা করে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেদনাবিধুর দিনে তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন শুরু করা নিয়ে সমাজে ক্ষোভ রয়েছে। ২১ আগস্ট স্বয়ং শেখ হাসিনার ওপর ভয়াবহ আক্রমণের ঘটনার পর বেগম জিয়ার উক্তিও ছিল অত্যন্ত অনুচিত ও নিষ্ঠুর ধরনের। তাঁর সরকারের আমলে সংঘটিত এই ঘটনার তদন্ত নিয়ে যে তামাশা করা হয়, সেটি ছিল প্রচণ্ড দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।
এসব সত্যি। কিন্তু আমরা অনেকে ভুলে যাই যে এত কিছুর পরও দুই নেত্রীর মধ্যে রাজনৈতিক সদ্ভাব ও সহমর্মিতা উবে যায়নি। এক–এগারোকালে শেখ হাসিনা বন্দী হলে খালেদা জিয়া তাঁর মুক্তির দাবি করেছিলেন। পরে খালেদা জিয়াও অন্তরীণ হলে পাশের ভবনে বন্দী শেখ হাসিনা তাঁকে রান্না করা খাবার পাঠিয়েছেন। পারিবারিক উৎসবে তাঁদের উপস্থিতির ঘটনাও আছে কিছু।
দুই নেত্রীর সম্পর্কে এমন উত্থান-পতন থাকতে পারে, শেখ হাসিনার মনে বঞ্চনা ও ক্ষোভ অনেক বেশি থাকতে পারে। রাজনীতিতে হয় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিন্তু বড় নেতারা এসবের ঊর্ধ্বে ওঠেন। আমরা তাই ডি ক্লার্ককে নেলসন ম্যান্ডেলার সরকারে দেখেছি, ভুট্টোকে বুকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে, আনোয়ার ইব্রাহিমকে দেখেছি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে জোট বাঁধতে।
দুই নেত্রীর সম্পর্কে এমন উত্থান-পতন থাকতে পারে, শেখ হাসিনার মনে বঞ্চনা ও ক্ষোভ অনেক বেশি থাকতে পারে। রাজনীতিতে হয় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিন্তু বড় নেতারা এসবের ঊর্ধ্বে ওঠেন। আমরা তাই ডি ক্লার্ককে নেলসন ম্যান্ডেলার সরকারে দেখেছি, ভুট্টোকে বুকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে, আনোয়ার ইব্রাহিমকে দেখেছি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে জোট বাঁধতে।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকার সময় শপথও থাকে রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্বে পালনের। এমন দায়িত্ববোধ থেকে শুধু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে খালেদা জিয়ার বিষয়টি দেখা সম্ভব। সারা দেশে তাঁর কোটি কোটি সমর্থকের অনুভূতির প্রতি মানবিক সহমর্মিতা দেখানোর জন্যও এটি প্রয়োজন। তাঁদের চোখে তিনি এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী নন। সত্যি কথা বলতে কি, যে মামলায় তিনি সাজা পেয়েছেন, তাতে এক টাকাও আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে এ ধরনের মামলায় সাজা রাজনৈতিকভাবে দেখা হয়, খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে অন্তত তাঁর সমর্থকেরা এভাবেই দেখছেন বিষয়টি।
তবে কার চোখে তিনি কী, এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনি তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, দুবারের বিরোধী দলের নেত্রী, কমপক্ষে ৩০টি আসনে নির্বাচিত সাংসদ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনি একজন মরণাপন্ন বয়োবৃদ্ধ নারী। শুধু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর চিকিৎসার বিষয়টি দেখার একমাত্র কারণ এটিই হতে পারে।
৩.
এ দেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে তিক্ততা, হিংসা ও প্রতিহিংসার বহু নজির রয়েছে। চিরস্থায়ী বিতর্ক ও বিরোধের উপজীব্য হয়ে আছে বহু ঘটনা। সুচিকিৎসা না পেয়ে খালেদা জিয়ার চরম কিছু ঘটলে এটিও তেমন একটি ঘটনা হিসেবে থাকবে। এর দায় নিয়ে বহু তিক্ততা হতে পারে, এমনকি কোনো এক সময়ে এটি নিয়ে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের হেনস্তা করার সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার বিষয়ে সুদৃষ্টি উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির নজির স্থাপন করতে পারে। আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন আ স ম আবদুর রব দণ্ড ভোগ করা অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিলেন সামরিক শাসনামলে। সামরিক শাসনামলের চেয়ে বর্তমান আমল নিশ্চয়ই কম মানবিক ও উদার নয়।
এই মানবিকতা প্রদর্শন করে বেগম জিয়াকে অনতিবিলম্বে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একেবারে শেষ সময়ে বিদেশে পাঠিয়ে তাঁর চিকিৎসাকে অসম্ভব করে তোলার আগেই এ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।