বাল্যবিবাহের পেছনে ছেলেমেয়েদেরই দুষলেন মেহের আফরোজ

বাল্যবিবাহ বন্ধের পথে আবারও বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদেরই দুষলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ (চুমকি)। এর আগেও তিনি বলেছিলেন, ছেলেমেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে বলেই বাল্যবিবাহ বাড়ছে।

গতকাল বুধবার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় কমিটির সভায় মেহের আফরোজ বলেন, শুধু অভিভাবকেরা সচেতন হলে হবে না, বাল্যবিবাহ বন্ধের বিষয়ে ছেলেমেয়েরাও যুক্ত। প্রকৃতিগতভাবেই বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এ কারণেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। সেখানে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা বিয়ের জন্য পাগল হয় না। ছেলেমেয়েদের এই বয়সের চাহিদা মেটাতে অভিভাবকেরাই সুযোগ করে দেন, বাংলাদেশে যা সম্ভব না।’

কমিটির সভাতেও করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে উল্লেখ করে আলোচকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

গত বছরের ২১ জানুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে সভাপতি করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। রাজধানীর ইস্কাটনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে মেহের আফরোজের বক্তব্য প্রসঙ্গে অন্য আলোচকেরা কোনো মন্তব্য করেননি।

মেহের আফরোজ এর আগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তখনো বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি বাল্যবিবাহের পেছনে ছেলেমেয়েদের দায়ী করে বক্তব্য দেন।

এর আগে গত ২৭ জুন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও অল্প বয়সের মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন মেহের আফরোজ। পরে ২৫ আগস্ট কমিটির পরবর্তী সভায় জানানো হয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি এ বিষয়ে একটি জরিপও পরিচালনা করছে।

বাল্যবিবাহ

বাল্যবিবাহ

গতকাল জাতীয় কমিটির সভায় যেসব পুরুষ অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে করছেন সামাজিকভাবে ওই পুরুষদের হেয় করা বা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার সুপারিশ করেন মেহের আফরোজ। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারে মেয়ের নিরাপত্তা, থাকার ঘরসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ বা নিষিদ্ধ করার জন্য চিৎকার করলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা বলেন, করোনার সময় বাল্যবিবাহ বাড়তে পারে। করোনায় অনেক পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। করোনার সময় প্রবাসীরা দেশে ফিরে এসেছেন। মা–বাবাও প্রবাসী ছেলে পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া কম বয়সী মেয়ের বিয়ে হলে যৌতুকও তুলনামূলক কম লাগে।

প্রতিমন্ত্রী ২০০৭ থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাল্যবিবাহের হারের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, বাল্যবিবাহের হার কমছে। ২০০৭ সালে ১৮ বছরের আগে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৭৪ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৫২ শতাংশের নিচে নেমে আসে। তবে ২০১৭ সালের পরের তথ্য তিনি উল্লেখ করেননি।

প্রতিমন্ত্রী জানান, সরকারের ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপকারভোগীদের পরিবারের কারও বাল্যবিবাহ হলে ওই উপকারভোগীর বরাদ্দ বাতিল করা হবে।

সভার সারাংশ তুলে ধরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, বিয়ের নিবন্ধনকে ডিজিটাল করতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত যেসব কমিটি আছে, ওই কমিটিগুলোকে কার্যকর ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো এবং মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেট থেকে একটি নির্দিষ্ট বরাদ্দ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।

সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব নারায়ণ চন্দ্র সরকার, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রাম চন্দ্র দাস, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বক্তব্য দেন।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা দেওয়া ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জেলা কমিটির তদারকি ও সমন্বয় করা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করা ও তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

গতকাল কমিটির সভা শেষে মেহের আফরোজের বক্তব্য প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নাকি তাদের শারীরিক চাহিদার কারণে হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো জরিপ নেই। তাই একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ওই বক্তব্য অস্বস্তিকর বলে মনে করি। নীতিনির্ধারকেরা যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন অভিভাবকেরাই বাল্যবিবাহে উৎসাহিত হন। এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার আগে নীতিনির্ধারকদের আরেকটু চিন্তাভাবনা করা উচিত।’

সূত্র : প্রথম আলো

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments