টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে একটা হতাশার নাম। ২০০৭ সালের প্রথম আসরেই আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই থেকে এখন পর্যন্ত ২০ ওভারের বিশ্বকাপে আর কোনো বড় দলের বিপক্ষে আমাদের জয় নেই।
হতাশা দিয়ে শুরু করলেও আজ আমি আশার কথাই বলব। আশা এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে। জানি না, আপনারা কে কী ভাবছেন, তবে আমি এবার অনেক বড় আশা নিয়েই তাকিয়ে আছি মাহমুদউল্লাহর দলের দিকে। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যাবে, ফাইনালে যাবে, এরপর…।
না, স্বপ্নের পরিধিটা এখনই আর না বাড়াই। তবে দলটাকে নিয়ে আমি এত আশাবাদী কেন, সেটা তো ব্যাখ্যা করতেই হয়। এই দল বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে দু-দুটো সিরিজ খুব ভালোভাবে জিতেছে। বিশ্ব ক্রিকেটের দুই বড় দলকে হারিয়ে তারা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ এবং নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৩-২–এ সিরিজ জেতা, সেটা যে কন্ডিশনেই হোক, সহজ নয়। এই দুই দলের ইতিহাসও তা–ই বলে। আমি মনে করি, আমাদের দলের জন্য জয়ের অভ্যাস নিয়ে বিশ্বকাপে যাওয়াটা অনেক ইতিবাচক দিক।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবাই ব্যাটিং কন্ডিশন আশা করছে। উইকেটে রানের ফল্গুধারা বইবে, এ–ই কল্পনায় ভাসছে। কিন্তু আইপিএল যতটুকু দেখেছি, সেখানে অত বেশি রান কিন্তু হয়নি। এমন নয় যে ১৮০-২০০ রান হয়েছে। রান থেকেছে ১৫০-১৬০–এর ভেতরে। এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে বলেই মনে করি। কারণ, ম্যাচ ১৫০-১৬০ রানের ভেতরে থাকলে আমাদের খেলোয়াড়েরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারবে।
টি-টোয়েন্টিকে সবাই বলে ব্যাটসম্যানদের খেলা। সবাই চায় রান হোক। রান না হলে আবার কিসের টি-টোয়েন্টি! কিন্তু একই সঙ্গে এখানে ম্যাচ জেতার জন্য বোলিংটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো বলি, খেলাটা একদিক দিয়ে বোলারদেরও। আমাদের বোলাররা সেখানে কেমন করে, সেটার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে।
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষেও বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের এমন হাসিমুখ দেখার অপেক্ষায় মাশরাফি
আর এখানেই আমার আশাটা বেশি। মোস্তাফিজ অসাধারণ বোলিং করছে এখন, দুর্দান্ত ফর্মে আছে। বিশ্বের সেরা বোলারদেরই একজন মনে করি আমি তাকে। সাইফউদ্দিন-শরীফুল খুব ভালো করছে। শরীফুল তো বিস্ময়কারভাবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দারুণ বোলিং করছে। সঙ্গে তাসকিন আছে। নিজেকে পরিবর্তন করে দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে গেছে ও। রুবেলও দলের সঙ্গে আছে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে। সব মিলিয়ে পেস বোলিং ইউনিটটা খুবই ভালো আমাদের। বৈচিত্র্যও অনেক।
স্পিনারদের প্রসঙ্গে সাকিবের কথা আলাদাভাবে কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না আমার। অনেক দিন ধরেই সে বিশ্বের সেরা। সঙ্গে নাসুম দারুণ ফর্মে আছে, খুব ভালো বোলিং করছে ও। অফ স্পিনার যারা আছে, তারাও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। মেহেদী তো প্রয়োজনের সময় ব্যাটিংয়েও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এটা দলের জন্য একটা বাড়তি সুবিধা।
আবারও বলি,বোলিং নিয়ে এত কথা বলার কারণ, টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানদের খেলা হলেও আমার মতে, এবারের বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে হলে আমাদের নির্ভরতা বেশি থাকবে বোলারদের ওপর। বাংলাদেশ দলের বোলিং আক্রমণটা সে রকম আশাজাগানিয়াও। যাদের কথা বললাম, তারা তো আছেই; সঙ্গে মাহমুদউল্লাহও প্রয়োজনে বল হাতে এগিয়ে আসতে পারে। আবার সাইফউদ্দিন মূলত বোলার হলেও ব্যাট হাতে তার দ্রুত রান তোলার সামর্থ্য আছে। কাজেই এখানে ওকে নেওয়া মানে একজন বোলার ও একজন অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান খেলানো। সাকিবের ব্যাপারটাও তা–ই।
সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে আমরা ভালো এবং ভারসাম্যপূর্ণ একটা দলই পাঠিয়েছি। দলে যারা অভিজ্ঞ, তাদের প্রতি অবচেতনেই আমাদের মধ্যে একটা বাড়তি প্রত্যাশা তৈরি হয়। আমার মনে হয়, ওরাও সেটা জানে এবং দলে নিজেদের ভূমিকাটা বোঝে। আর বাংলাদেশের হয়ে যারা চার-পাঁচ বছর ক্রিকেট খেলে ফেলেছে, তাদেরও এখন আর আমি জুনিয়র বলব না। বয়সে হয়তো ওরা ছোট, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আবহে তো তারা অনেক দিন ধরেই আছে। বিশ্বকাপও খেলে ফেলেছে কেউ কেউ। সৌম্যর তো দুটি বিশ্বকাপ খেলারই অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, আফিফ-শামীমদের মতো কিছু নতুন মুখও আছে দলে। তবে আফিফও কিন্তু ব্যাটিংয়ে দারুণ ফর্মে আছে। নুরুল হাসান দীর্ঘদিন দলের আশপাশে আছে, দলের হয়ে খেলেছেও। ওর অভিজ্ঞতা যথেষ্টই বলব।
তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার এই মেলবন্ধনই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমাদের সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। দলটাকে সে কারণেই আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। আমিসহ পুরো দেশের মানুষেরই আশা, আমাদের এই দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভালো কিছু করবে। হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটকেই চমকে দেবে তারা।
প্রথম রাউন্ডে আমরা খুব ভালোভাবেই উতরে যাব বলে আমার বিশ্বাস। দ্বিতীয় রাউন্ডে আমরা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়তো হব। দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা এবং টিম ম্যানেজমেন্ট মিলে নিশ্চয়ই সেই চ্যালেঞ্জ টপকানোর কৌশলও বের করে ফেলবে। দলের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনাটাই নিশ্চয়ই তারা করবে।
বিশ্বকাপে কন্ডিশন ও উইকেট বোঝাটা খুব জরুরি। অবশ্য কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের দল একটু আগেই ওমান চলে গেছে। মাসকাটে তারা একটা প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেছে। আবুধাবিতেও প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে। তবে প্রস্তুতি ম্যাচের ফলাফলকে আমি বড় করে দেখছি না। এসব মূলত কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারই উপলক্ষ ছিল। আমার বিশ্বাস, সে কাজ আমাদের খেলোয়াড়েরা ভালোভাবেই করেছে।
এখন বিশ্বকাপেও পরিকল্পনামতো বাকি কাজটা হবে। আমি নিশ্চিত, দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় জানে, তাদের কার কী করণীয়। মাঠে সে অনুযায়ী সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটাতে পারলেই আসবে কাঙ্ক্ষিত ফল। তবে সে জন্য বাড়তি চাপ নেওয়া যাবে না। বাইরে থেকে নানা ধরনের কথা আসবে, সেগুলোও এড়িয়ে চলতে হবে। আমার পরামর্শ, যার যার স্বাভাবিক খেলাটাতেই সবাই মনোযোগী হোক। তাহলেই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে আমাদের।
বাংলাদেশ দলের কাছে সবার যা প্রত্যাশা, আমারও তা–ই। ইনশা আল্লাহ আমরা সেমিফাইনালে খেলব। সেটাই হবে একটা বড় স্বপ্নপূরণ। আর সেমিফাইনালের পর তো আসলে এক ম্যাচ করে হিসাব। যদিও শুরু থেকেই তা–ই, তবু সেমিফাইনালের হিসাবটা একটু ভিন্ন। এখানে নির্দিষ্ট দিনে ভালো খেলতেই হয়। গ্রুপ পর্বে একটা ম্যাচে ভালো না করলেও ফিরে আসার সুযোগ থাকে। কাজেই ম্যাচ ধরে ধরে আমাদের সেমিফাইনালের দিকে চোখ রেখে এগোতে হবে। বাংলাদেশ দলও নিশ্চয়ই সেভাবেই ভাবছে।
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে আলাদা করেই কিছু কথা বলা দরকার। দলকে দারুণভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে। মাঠে ও মাঠের বাইরে খুবই সক্রিয় একজন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। দলটাকে অনেক ভালোভাবে গুছিয়ে এনেছে। এখন বাকিদের কাছ থেকে সময়োপযোগী সমর্থন পেলে বড় কিছু আশা করাটা বাড়াবাড়ি হবে না।
মাহমুদউল্লাহর সবচেয়ে বড় শক্তি, দলে সাকিবের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞ ও অন্যতম সফল একজন খেলোয়াড় আছে। মুশফিকের মতো অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান আছে। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ নিজেও অসাধারণ ফর্মে আছে ব্যাটসম্যান হিসেবে। সঙ্গে তরুণেরা তো আছেই, যারা প্রত্যেকেই জানে তাদের করণীয় কী।
সব মিলিয়ে বলব, এবারের বিশ্বকাপে ভালো কিছু করার সামর্থ্য আমাদের অবশ্যই আছে। শুধু মনের মধ্যে বিশ্বাসটা আনতে হবে যে আমরা ভালো কিছু করতে পারি। সব ধরনের নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে খেলতে হবে। তাহলেই পূরণ হবে সেমিফাইনাল, ফাইনালের স্বপ্ন। ফাইনালের পরের গল্পটাও লেখা হবে সোনালি হরফে। বাংলাদেশ দলের জন্য থাকল সেই শুভকামনা।
সূত্র : প্রথম আলো