বিশ্বকাপে দলে সাকিবের ভূমিকা কী হবে? অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কাছে কী প্রত্যাশা? তরুণ আফিফ–শরীফুলদেরই–বা ভালো করার সম্ভাবনা কতটুকু? সেসবই বিশ্লেষণ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক বাঁহাতি স্পিনার ও বর্তমানে বিসিবির নির্বাচক—লেখা:আবদুর রাজ্জাকপ্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২১।
বিশ্বকাপটা যখন টি-টোয়েন্টি সংস্করণে, তখন আমার আশা দলের সবাইকে নিয়েই। আমরা এর আগে টি-টোয়েন্টিতে তেমন একটা ভালো দল ছিলাম না। দলের মধ্যে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের আরেকটু মিশেল, দলের সমন্বয়টা একটু পরিবর্তন করে যদি আরেকটু ভালো অবস্থানে যাওয়া যায়—আমাদের এখনকার চেষ্টাটা এ রকমই।
দলে নতুন আসাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে সব সময় কেমন একটা উদাসীনতা কাজ করে। আমরা ধরেই নিই—ও তো নতুন এসেছে, ওর এমন কীই–বা দায়িত্ব! আমি মনে করি, এভাবে ভাবাটা ঠিক নয়। জাতীয় দলে দায়িত্ব সবারই সমান। যদি কেউ অন্যভাবে চিন্তা করে, তাহলে তার ক্যারিয়ারের গতিপথটাও অন্য রকম হবে। আমার মতে, নতুন হোক, পুরোনো হোক, তরুণ হোক বা একটু অভিজ্ঞই হোক না কেন, দায়িত্ব সবাইকেই সমানভাবে নিতে হবে।
নতুন কাউকে দলে নিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টিটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মঞ্চ। এবার যারা মোটামুটি নতুন—আফিফ হোসেন, শামীম হোসেন, মোহাম্মদ নাঈম, শরীফুল ইসলামসহ বাকিরা কিন্তু যথেষ্টই ভালো করেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
আমার আশা থাকবে, সবাই যেন ভালো করতে পারে। এরপরও বাড়তি নজরের কথা বললে মুশফিকুর রহিম, মোস্তাফিজুর রহমান, সাকিব আল হাসানের সঙ্গে আফিফ হোসেনের দিকেই তাকিয়ে থাকব। এ তালিকায় শরীফুলও আছে।
মুশফিকের কথা যদি বলি, ও যে মানের ক্রিকেটার, সে ভালো খেললে দল অনেকটাই এগিয়ে যায়। সেদিক থেকে আমাদের জন্য মুশফিকের ভালো খেলাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো নিউজিল্যান্ড সিরিজে সে খুব একটা ভালো করেনি। তবে মুশফিকের মতো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে দু–একটা সিরিজ এদিক-সেদিক হওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। বিশ্বকাপে ওর ফর্মটা কেমন হবে—আমি আসলে সেভাবে ভাবছিই না। আমি ওকে নিয়ে মোটেই চিন্তিত নই।
মোস্তাফিজ আইপিএলে নিয়মিত খেলেছে। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ওর তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সে এখন অভিজ্ঞও, আমাদের পেস আক্রমণের নেতৃত্বে আছে সে। তার বোলিংয়ের ব্যাপারে বলার তেমন কিছু নেই। আমি আসলে চাই না মোস্তাফিজের ওপর বাড়তি কোনো চাপ পড়ুক। আমি চাই তাকে তার মতো খেলতে দেওয়া হোক। আশা তো মোস্তাফিজকে নিয়ে আছেই, দলের মূল খেলোয়াড়দের একজন সে। তবে বাড়তি প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দিতে চাই না কারোর ওপরই।
অভিজ্ঞ সাকিব-মোস্তাফিজ-মুশফিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে তরুণ নাসুম-নাঈমদের নিয়েও
আমাদের পেসাররা কয়েক বছর ধরেই ভালো করছে। তাসকিন আহমেদ বলেন বা শরীফুল—সবাই। শরীফুলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। টি-টোয়েন্টি সংস্করণটা একটু অন্য রকম, তবে আমার মনে হয় সে ভালো করবে। সাইফউদ্দিন দেশে শেষ কয়েকটা ম্যাচে ভালো করে গেছে। রুবেল হোসেন মূল দলের সঙ্গে না থাকলেও তার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে আমাদের।
আর স্পিনে তো সাকিব আছেই। এমনিতেও আমাদের স্পিন বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা সাকিবের বোলিং। বাকি যারা আছে, তাদের সবারই সামর্থ্য আছে ভালো করার। দলের জন্য যা দরকার হয়, সেটা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। নাসুম আহমেদ বেশ ভালো করেছে। মেহেদী হাসান প্রমাণ করেছে, সে টি-টোয়েন্টির জন্য দারুণ একজন স্পিনার। সেদিক থেকে দেখলে বোলিং বিভাগ বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আমাদের স্পিনাররাও সব সময়ই কমবেশি ভালো করে, এবারও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।
শুধু স্পিনার হিসেবে নয়, সাকিব সবদিক দিয়েই দলের মূল খেলোয়াড়। তার কাছে আমার চাওয়াটা সরল—মাঠে সাকিবকে আমি মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকাতেই দেখতে চাই। দলের সবচেয়ে বড় তারকা সে, আলাদা করে বলার কীই–বা আছে!
মনে হতে পারে, প্রত্যাশাটা একটু বেশি হয়ে গেল কি না তার ওপর। তবে আমি নিশ্চিত, এসব ভেবে সাকিব বাড়তি চাপ নেবে না। দলকে জেতানোর জন্য যে অবদানটা রাখা দরকার ওর দিক থেকে, সেটাই তার কাছ থেকে পাব আমরা। সেটা ব্যাটিং-বোলিং–ফিল্ডিং—সব বিভাগেই।বিজ্ঞাপনnull
আমাদের প্রতিটা বিভাগই বেশ ভালো অবস্থানে আছে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো পরিস্থিতির চাপ সামলানো। কে কত ভালোভাবে চাপটা সামলাতে পারবে, সেটার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। কারণ, বিশ্বকাপের মতো এমন টুর্নামেন্টে চাপটাই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতে দলের মান বা প্রস্তুতি নিয়ে কোনো কথা নেই।
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কত্বে টানা তিনটি সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ওর অধিনায়কত্বে তেমন কিছু যদি না-ই থাকে, তাহলে তো দলের এভাবে পারফর্ম করাটা সম্ভব হতো না। আমার তাকে ‘স্মার্ট’ একজন অধিনায়কই মনে হয়, বিশ্বকাপেও তেমন অধিনায়কত্বই চাইব মাহমুদউল্লাহর কাছে।
ব্যাটিংয়ের প্রসঙ্গে আসি। টপ অর্ডারে তামিমের অনুপস্থিতিটাই হয়তো এই দলের একমাত্র ঘাটতির জায়গা। তবে যারা আছে, তাদের সামর্থ্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সেটা সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ নাঈম বা লিটন দাস—যার কথাই বলি না কেন। লিটনকে নিয়ে আমার আশা, সে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরবে। সেটা করতে পারলে এ টুর্নামেন্টে লিটনের ভালো কিছু করার ভালো সম্ভাবনাই আছে।
তবে আমি বেশি রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষায় আছি আফিফের খেলা দেখার। সে ভালো করবে, এই আস্থা তার ওপর আমার আছে। আফিফকে নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে খেললে বিশ্বকাপে আফিফের ভালো করাটা শুধুই সময়ের ব্যাপার।
আমাদের এবারের দলটা আমার চোখে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সেরা দল। তামিম থাকলে হয়তো ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হতো। তবে যারা দলে আছে, সাম্প্রতিক সময়ে তারা সবাই বেশ ভালো খেলেছে। তামিমের অভাব নিশ্চয়ই পুষিয়ে দেবে।
যেকোনো বড় টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। পরপর তিনিটি সিরিজ জিতে আমাদের দলটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে গেছে। এখন দেখার অপেক্ষা ওরা কন্ডিশনের সঙ্গে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারে, চাপ কতটা সামাল দিতে পারে। ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা সময় বলবে। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ দল এবার যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, মাঠে সেটার প্রতিফলন দেখা গেলে ভালো না করার কোনো কারণ নেই। সেই আশা নিয়েই বিশ্বকাপ দেখার অপেক্ষায় আছি।
আবদুর রাজ্জাক: জাতীয় দলের নির্বাচক ও সাবেক বাঁহাতি স্পিনার
সূত্র : প্রথম আলো